বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫

ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি, ট্রাম্পের ‘বিজয়’ প্রচার ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা

মধ্যপ্রাচ্যে টানা ১২ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে এক নাজুক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। এই যুদ্ধবিরতির মূল মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের অবস্থানকে কূটনৈতিক ও সামরিক ‘বিজয়’ হিসেবে তুলে ধরছেন। কিন্তু বাস্তবতা বলছে—এ বিজয়ের আড়ালে রয়ে গেছে বহু অনিশ্চয়তা, অপূর্ণতা ও কৌশলগত দ্বন্দ্ব।

এয়ার ফোর্স ওয়ানে করে ন্যাটো সম্মেলনের পথে থাকা অবস্থায় ট্রাম্প একটি ব্যক্তিগত বার্তা প্রকাশ করেন, যা পাঠিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান ন্যাটো প্রধান মার্ক রুটে। তিনি বার্তায় ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের বোমারু বিমানের হামলা ছিল দুঃসাহসিক ও অভূতপূর্ব।” ট্রাম্প সেই বার্তাটি ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে পোস্ট করেন—যা তার কূটনৈতিক জয়গান প্রচারের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ইরানে পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প

এমন এক সময়ে এই প্রশংসাবাণী এল, যখন এক সপ্তাহ আগেই কানাডায় অনুষ্ঠিত জি৭ সম্মেলন থেকে ট্রাম্প আগেভাগেই চলে যান। কারণ তখন ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল এবং আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে। পরিস্থিতি রক্ষায় ট্রাম্প প্রশাসন শনিবার রাতে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়। সেই হামলার পরই যুদ্ধবিরতির আলোচনা ত্বরান্বিত হয় এবং মঙ্গলবার সকালে ওয়াশিংটন ত্যাগ করেন প্রেসিডেন্ট, ন্যাটো সম্মেলনের উদ্দেশ্যে।

হোয়াইট হাউজের বক্তব্য অনুযায়ী, এই সামরিক হামলার মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করা হয়েছে এবং সেটিই যুদ্ধবিরতির পথ প্রশস্ত করেছে। এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পক্ষ থেকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে একটি “অত্যন্ত কঠোর ও সরাসরি” ফোনালাপ সংঘর্ষ থামানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে দাবি করা হয়। ট্রাম্প নিজেই এই সংঘর্ষকে ‘১২ ডে ওয়ার’ বলে অভিহিত করেছেন।

তবে মার্কিন সামরিক গোয়েন্দাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনে ভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে। তাদের মতে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস হয়নি, বরং কেবল কয়েক মাস পিছিয়ে গেছে। দেশটির সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ ধ্বংস হয়নি এবং একটি অপ্রকাশিত গবেষণা কেন্দ্র এখনও অক্ষত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সিবিএস নিউজসহ একাধিক মার্কিন সংবাদমাধ্যম এই গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে জানিয়েছে, “হোয়াইট হাউজের দাবি বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে মিলছে না।”

এরপরও ট্রাম্প রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। তার দলের ভেতর থেকে সমালোচনার স্বর আপাতত স্তিমিত হয়েছে। কেন্টাকির রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান থমাস ম্যাসি, যিনি প্রেসিডেন্টের ইরান নীতির বিরোধিতা করে একটি আইন প্রস্তাব আনার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তিনিও বর্তমানে সেই উদ্যোগ স্থগিত করেছেন।

এদিকে, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এক পোস্টে ট্রাম্পের ‘ফরেন পলিসি ডকট্রিন’ তিনটি ধাপে ব্যাখ্যা করেন—“১) আমেরিকার স্বার্থ স্পষ্টভাবে নির্ধারণ, ২) তা অর্জনের জন্য আগ্রাসী কূটনীতি, ৩) প্রয়োজনে প্রবল সামরিক শক্তি প্রয়োগ।” বিশ্লেষকেরা এটিকে একটি প্রতিক্রিয়াশীল এবং ঘটনাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে দেখছেন, যা কৌশলগত গভীরতা থেকে বঞ্চিত।

তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণে এখনও প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে—এই যুদ্ধবিরতি কতটা স্থায়ী হবে? মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিরতির ইতিহাস খুব সুখকর নয়। ইরানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুই সপ্তাহের ইসরায়েলি হামলায় দুর্বল হয়ে পড়েছে, যা দেশটিতে অভ্যন্তরীণ সংকট আরও ঘনীভূত করতে পারে। সিরিয়া, লিবিয়া বা ইয়েমেনের উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট যে, এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতা শূন্যতা আরও ভয়াবহ সংঘাতে রূপ নিতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প হয়তো একটি যুদ্ধ থামিয়েছেন, কিন্তু বৃহত্তর সংকটকে মুলতবি করেছেন মাত্র। একইসঙ্গে গাজা ও ইউক্রেনের যুদ্ধ এখনো অব্যাহত—যেগুলো ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বন্ধ করতে চেয়েছিলেন।

এই মুহূর্তে ট্রাম্পের জন্য রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি অনুকূলে। কিন্তু বাস্তব ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বলছে, ট্রাম্পের বিজয়গাথার পেছনে রয়েছে এক অস্থির বাস্তবতা, যেটি যে কোনো মুহূর্তে নতুন সংকট তৈরি করতে পারে।