শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫

গাজায় ধ্বংসের নতুন অধ্যায়: পরিকল্পিতভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে হাজারো ভবন

১৮ জুলাই ২০২৫

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনী ব্যাপক হারে পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। মার্চ মাসে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির অবসানের পর থেকে ইসরায়েল এই অভিযান জোরদার করেছে। বিগত কয়েক সপ্তাহে বহু শহর ও আবাসিক এলাকা পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এক সময় যেখানে হাজার হাজার মানুষ বসবাস করতেন, আজ সেখানে শুধুই ধ্বংসস্তূপ পড়ে আছে।

BBC Verify এর অনুসন্ধানে দেখা যায়, এসব ধ্বংসের অনেকটাই ঘটেছে নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ এবং কৌশলগত বুলডোজিংয়ের মাধ্যমে। উপগ্রহ চিত্র এবং যাচাই করা ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বিভিন্ন ভবন, স্কুল ও অবকাঠামোতে পরিকল্পিতভাবে বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু ভবন আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত ছিল, তবে অনেক ভবন ছিল মূলত অক্ষত।

ইসরায়েল দাবি করছে, তারা ‘সামরিক প্রয়োজনে’ এসব ধ্বংস করছে, কারণ হামাস এসব ভবনে সামরিক স্থাপনা গড়ে তুলেছে। তবে মানবাধিকার আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের এমন ধ্বংসযজ্ঞ চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হতে পারে।

রাফাহ শহর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শহরটির টেল আল-সুলতান এলাকার একমাত্র বিশেষায়িত মাতৃসদন হাসপাতাল এবং এতিম শিশুদের একটি কেন্দ্র ছাড়া প্রায় সব ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। ১৩ জুলাইয়ের মধ্যে পুরো এলাকাটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

আশেপাশের সৌদি পাড়া, যেটি এক সময় রাফাহর সবচেয়ে বড় মসজিদ ও একাধিক স্কুলের আবাস ছিল, সেখানেও একই রকম নিয়ন্ত্রিত ধ্বংস চলছে। যাচাই করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ট্যাংক রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে এবং পাশেই একটি ডিগার মাটিতে খনন কাজ করছে।

খুজা’আ এবং আবাসান আল-কাবিরা শহরেও একই ধরণের ধ্বংসযজ্ঞের প্রমাণ মিলেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী খুজা’আয় ১২০০ ভবন ধ্বংসের দাবি করেছে এবং জানিয়েছে, এসব ভবন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অংশ ছিল। অথচ যুদ্ধের আগে শহরটির জনসংখ্যা ছিল ১১ হাজার এবং এটি ছিল কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। একইভাবে আবাসান আল-কাবিরায় প্রায় ২৭ হাজার মানুষ বাস করতেন, যেখানে মাত্র ৩৮ দিনের ব্যবধানে বিস্তীর্ণ এলাকা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

গাজা উপত্যকার বিভিন্ন অঞ্চলে ইসরায়েল ‘নিরাপত্তা করিডোর’ এবং ‘বাফার জোন’ গড়ে তুলছে। এর ফলে গাজার পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কিজান আবু রাশওয়ান নামের একটি কৃষি গ্রাম, যা ইসরায়েল সীমান্ত থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে, সেখানে মে মাসের পর থেকে প্রায় সব অবশিষ্ট ভবন ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।

এই অভিযান আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হয়েছে। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট বলেন, রাফাহ শহরে ‘মানবিক শহর’ গড়ার পরিকল্পনা আসলে একটি বন্দিশিবির তৈরি করার সামিল। এ পরিকল্পনায় প্রাথমিকভাবে ৬ লাখ ফিলিস্তিনিকে সীমাবদ্ধ রাখা হবে বলে জানা গেছে।

BBC Verify এই ধ্বংসযজ্ঞের জন্য সামরিক ব্যাখ্যা চেয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর কাছে প্রশ্ন করলে তারা নির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। বরং তারা সাধারণভাবে জানায়, হামাস তাদের সামরিক অবকাঠামো বেসামরিক ভবনের মধ্যে গড়ে তোলে এবং এই কারণে এসব ভবন ধ্বংস করা হচ্ছে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ভবিষ্যতে কোন স্থাপনা সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহৃত হতে পারে—এই আশঙ্কায় ভবন ধ্বংস করা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনে অনুমোদিত নয়। যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও বেসামরিক নাগরিকদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হয়, যা এই ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এদিকে, ইসরায়েলি মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরবরাহকৃত ডোজেন ডোজেন বুলডোজার ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে এসেছে, যা ধ্বংস কার্যক্রমকে আরও গতি দিচ্ছে। এছাড়া গাজায় নির্মাণকাজে নিয়োজিত হওয়ার জন্য ইসরায়েলি ফেসবুক গ্রুপগুলোতে বহু নিয়োগ বিজ্ঞাপনও দেখা গেছে, যেগুলোতে নির্দিষ্ট এলাকায় কাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এভাবে গাজার ভূমিতে চলমান পরিকল্পিত ধ্বংস অভিযানে ভবিষ্যতের জন্য গঠনমূলক পুনর্বাসন বা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের যে আশাবাদ ছিল, তা গভীর অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।

একজন গাজাবাসী, মোয়াতাজ ইউসুফ আল-আবসি, বলেন তিনি যুদ্ধ শুরুর এক বছর আগে নিজের নতুন বাড়িতে উঠেছিলেন। তাঁর ভাষায়, “স্বপ্ন দেখতাম একটা স্থায়ী জীবনের। এখন সব শেষ। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নেই।”

তথ্যসূত্র: BBC Verify, Planet Labs, Maxar, বিভিন্ন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক সংস্থা


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন