শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫

ব্যাংক খাতের দুর্বলতায় ধুঁকছে অর্থনীতি, স্থবির বিনিয়োগে অস্থির ব্যবসায়ী সমাজ

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের নীতিগত দুর্বলতা, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতা এবং প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতার কারণে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরছে না। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে।

নানা সংস্কারের ঘোষণা সত্ত্বেও, বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো “পুরনো বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে।”

পুরনো চিত্রেই ব্যাংক খাত

ব্যাংক খাতের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও উদ্যোক্তাদের অভিমত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পরিস্থিতি আগের মতোই রয়ে গেছে। কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ পরিবর্তন এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য নগদ সহায়তা ছাড়া কাঙ্ক্ষিত কাঠামোগত পরিবর্তন হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা থেকে অর্থনীতিকে টেনে তুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি সাপোর্ট প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কার্যকর বাস্তবায়ন না হওয়ায় সেই সুফল দেখা যাচ্ছে না। ফলে বিনিয়োগ থমকে আছে, নতুন উদ্যোগ কমছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি মন্থর।

বিজিএমইএ, ব্যবসায়ী নেতারা এবং উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ব্যবসা পরিচালনায় অনুকূল পরিবেশ অনুপস্থিত। উচ্চ সুদের হার, ব্যাংক ঋণ গ্রহণের জটিলতা, আমলাতান্ত্রিক ঝামেলা এবং নীতি স্থিতিশীলতার অভাব উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করছে।

এক ব্যবসায়ী বলেন, “যত দিন যাচ্ছে, আমাদের ব্যবসা পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। ঋণের সুদ ১৪-১৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছে। সেই সঙ্গে ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি আমাদের মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলেছে।”

খেলাপি ঋণের নতুন বাস্তবতা

বাংলাদেশ ব্যাংক এপ্রিল ২০২৫ থেকে ঋণ শ্রেণীকরণ নীতি কঠোর করেছে। এখন তিন মাসের বেশি বকেয়া পড়লে ঋণ সরাসরি খেলাপি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এর ফলে ঋণ লুকানোর সুযোগ কমলেও হঠাৎ করে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ দুই-তিন গুণ বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ ২০২৫ শেষে ব্যাংকিং খাতে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কিছু ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাবে বড় গ্রাহকের অনিয়মিত ঋণ পুনঃতফসিল করে খেলাপি হিসেবে দেখাত না। নতুন নিয়মে সেই ঋণগুলো প্রকাশ পাচ্ছে, যা ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, “নিয়মের কঠোরতা অপরিহার্য, কিন্তু অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা না করে শুধু আইন প্রয়োগ করলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল প্রতিষ্ঠান এবং অর্থনীতির মন্দা মিলিয়ে খেলাপি ঋণ সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠেছে।”

বড় ঋণ সহায়তা ‘যাচাই-বাছাইয়ে’ আটকে

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বড় ঋণ পুনঃতফসিলে সহায়তার জন্য কমিটি গঠন করলেও সাড়ে পাঁচ মাসে তেমন অগ্রগতি হয়নি। এ পর্যন্ত ১,২৫০টি আবেদন জমা পড়লেও যাচাই-বাছাই হয়েছে মাত্র ১০০টি।

বিজিএমইএ-র পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীকে জানানো হয়েছে, ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা ছয় মাসে উন্নীত করতে হবে। তাদের দাবি, এই ব্যবস্থা কার্যকর হলে ৫০০-৬০০ পোশাক কারখানা ক্লাসিফায়েড ঋণ থেকে রক্ষা পাবে।

উচ্চ সুদের ফাঁদে বিনিয়োগ স্থবিরতা

নীতিসূদহার একাধিকবার বাড়ানোর কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে নেমেছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, উৎপাদনশীল খাতে নতুন বিনিয়োগ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “ব্যাংক খাত পুনরুদ্ধার করতে সময় লাগছে। আগের সরকারের আমলে ব্যাংক খাত নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে চলে গিয়েছিল। আমরা সেটা পরিবর্তনের চেষ্টা করছি। তবে প্রক্রিয়াটি সহজ নয়।”

অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (মুদ্রানীতি বিভাগ) ড. মো. এজাজুল ইসলাম বলেন, “৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ ছিল ভয়াবহ ভুল। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়েনি, বরং অর্থ পাচার বেড়েছে। শুধু সুদহার কমালেই বিনিয়োগ হয় না।”

ডলারের দামে ধস

ডলারের বিনিময় হার ৮৫ টাকা থেকে ১২০ টাকার কাছাকাছি চলে গেছে। এতে আমদানিনির্ভর খাত চরম বিপাকে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, একই পণ্য আমদানি করতে ৩০-৪০ শতাংশ বেশি টাকা খরচ হচ্ছে। অনেকেই এলসি বাতিল করছেন, কেউ উৎপাদন সীমিত করছেন।

এক আমদানিকারক বলেন, “ডলারের ঝাঁপিয়ে পড়া দামে আমাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। পুঁজি শেষ হয়ে যাচ্ছে।”

অর্থনীতির ভবিষ্যৎ কী?

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধু আইন কঠোর করলেই ব্যাংক খাতের সংস্কার সম্ভব নয়। দরকার দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত পরিবর্তন, স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ।

এক অর্থনীতিবিদ বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেসব নীতিমালা প্রণয়ন হচ্ছে, তা বাস্তবে ব্যবসার জন্য কতটা সহায়ক, তা বিশ্লেষণ জরুরি। বাস্তবায়নে দেরি করলে সংকট আরও গভীর হবে।”

ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, যাতে অর্থনীতির চাকা আবার ঘুরতে শুরু করে।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন