শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫

ট্রাম্পের ঘাঁটিতেই বিভাজন: ‘ইসরায়েলকে বাদ দিন’—ইরান আগ্রাসনে মার্কিন ডানপন্থীদের হুঁশিয়ারি

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ইরান আক্রমণের ঘটনায় মার্কিন রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে গভীর বিভাজন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো—এই বিভাজন ঘটছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিজ রাজনৈতিক ঘাঁটিতেই।

মার্কিন সেনা জড়িত হতে পারে—এমন শঙ্কা তৈরি হওয়ায় ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির প্রবক্তা ট্রাম্পের সমর্থক অনেক ডানপন্থী রাজনৈতিক নেতা, বিশ্লেষক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব প্রকাশ্যে ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। তারা মনে করছেন, এই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী এবং এটি ট্রাম্পের শান্তির প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

ট্রাম্প বলেছিলেন, “সব যুদ্ধ বন্ধ করব”

দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, “আমি শান্তির দূত হব, একতাবদ্ধ করব জাতিকে।” কিন্তু মাত্র ছয় মাসেই মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধ পরিস্থিতি তাঁর প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

ইসরায়েলের ইরান আক্রমণকে ট্রাম্প সরাসরি অনুমোদন না দিলেও আগেভাগেই জানতেন বলে স্বীকার করেছেন। একই সঙ্গে বলেছেন, “ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারবে না—তবে আমরা তাদের উন্নতির জন্য সাহায্য করতেও প্রস্তুত।”

ডানপন্থীদের কণ্ঠে প্রতিরোধ: “ইসরায়েলকে বাদ দিন”

ট্রাম্পের প্রভাবশালী সমর্থক, রক্ষণশীল ভাষ্যকার টাকার কার্লসন তার নেটওয়ার্কের বার্তায় বলেন,

“ইসরায়েল চাইলে যুদ্ধ করুক—তাদের অধিকার আছে। কিন্তু সেটা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে নয়। এই যুদ্ধ হাজারো আমেরিকান প্রাণ নিতে পারে বা সন্ত্রাসবাদের নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করতে পারে।”

তিনি সরাসরিই বলেন, “একটি বিকল্প আছে: ইসরায়েলকে বাদ দিন। ওরা নিজের যুদ্ধ নিজেরাই লড়ুক।”

রিপাবলিকান সিনেটর র‍্যান্ড পল ও কংগ্রেসওম্যান মারজোরি টেলর গ্রিন—দুজনেই যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। গ্রিন স্পষ্টত বলেছেন, “আমি শান্তির জন্য প্রার্থনা করছি—এটাই আমার অবস্থান।” অন্যদিকে, র‍্যান্ড পল বলেন, “আমেরিকানরা আর যুদ্ধ চায় না। ট্রাম্প ২০২৪ সালে এই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতেই নির্বাচিত হয়েছেন। এখন তিনি যেন তার নীতিতে অটল থাকেন।”

ট্রাম্পের গোয়েন্দা প্রধান টুলসি গ্যাবার্ড মার্চে কংগ্রেসে সাক্ষ্য দিয়েছেন, “আমরা এখনও মনে করি, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে না।”

যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন ট্রাম্প?

কূটনীতি প্রচারক মার্কিন থিঙ্কট্যাংক কুইন্সি ইনস্টিটিউটের নির্বাহী সহসভাপতি ত্রিতা পার্সি বলেন,

“ট্রাম্প আসলে কৌশলে ইরানের সঙ্গে চুক্তি চেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু যখন তিনি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ পুরোপুরি বন্ধের দাবি তোলেন, তখন আলোচনা অবরুদ্ধ হয়। ইসরায়েল সেই সুযোগে তাকে যুদ্ধের পথে টেনে নিয়েছে।”

পার্সি অভিযোগ করেন, ট্রাম্প কৌশলে ‘শান্তিপূর্ণ বক্তব্য’ দিয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি আগেই জানতেন ইসরায়েল হামলা চালাবে।

রিপাবলিকানদের তরুণদের মনোভাবেও পরিবর্তন

ক্যাটো ইনস্টিটিউটের গবেষক জন হফম্যান বলেন,

“৫০ বছরের নিচের রিপাবলিকানদের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বেড়েছে। নতুন প্রজন্ম এই ধরনের যুদ্ধকে সমর্থন করে না।”

সম্প্রতি পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপেও দেখা যায়, রিপাবলিকানদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ ইসরায়েল বিষয়ে সংশয় পোষণ করছে।

অতীতের যুদ্ধে ক্লান্ত আমেরিকা

ইরাক ও আফগানিস্তানে জর্জ ডব্লিউ বুশের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এখনো অনেক মার্কিন নাগরিকের মনে তিক্ত স্মৃতি। যুদ্ধের নামে হাজারো আমেরিকান প্রাণ হারানো ও কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেও কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ার বাস্তবতা ট্রাম্পের সমর্থকদের মধ্যে যুদ্ধবিরোধী মনোভাবকে তীব্র করেছে।

ট্রাম্প নিজেও ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন,

“আমার সময় হলে আফগানিস্তানে এমন লজ্জাজনক পরিণতি হতো না। ওটা আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জার মুহূর্ত।”

একদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের ইসরায়েল ঘনিষ্ঠ অবস্থান, অন্যদিকে তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ঘরানার যুদ্ধবিরোধী অবস্থান—এই দ্বৈত সংকটে পড়েছে হোয়াইট হাউস। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধের মুখে পড়তে পারে—যার দায় এককভাবে শুধু বাইরের নয়, বরং ভেতরের দ্বিধান্বিত নেতৃত্বেরও।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন