শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫

ট্রাম্প-সংকটে কোরিয়া: প্রেসিডেন্ট লির সামনে পারফেক্ট স্টর্ম

দক্ষিণ কোরিয়ার সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লি জে-মিয়ং দেশের নেতৃত্বে এসেছেন এক চরম সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে। মার্শাল ল’ জারির চেষ্টার দায়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওলের ইমপিচমেন্টের পর লি ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই—যা কোরিয়ার রাজনীতিতে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। তবে তার সামনে সময় নেই স্বস্তির কোনো ‘হানিমুন পিরিয়ড’ কাটানোর। কারণ, একদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভক্তি এবং অর্থনৈতিক মন্দা, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রাসী নীতির ফলে দক্ষিণ কোরিয়া দাঁড়িয়ে আছে এক সম্ভাব্য পারফেক্ট স্টর্মের সামনে।

প্রেসিডেন্ট লির শপথের আগেই ট্রাম্প কোরিয়ার বিরুদ্ধে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন, যা দেশটির অর্থনীতির জন্য একটি ভয়াবহ ধাক্কা হতে পারে। রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি এবং স্টিল ও গাড়ি শিল্পে এর প্রভাব পড়বে সর্বাধিক। দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি এমনিতেই গত প্রান্তিকে সংকুচিত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের শুল্ক নীতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। প্রেসিডেন্ট লির উপদেষ্টা মুন চুং-ইন এই পরিস্থিতিকে “সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকট” হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

এদিকে শুধু অর্থনীতি নয়, দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তাও রয়েছে চ্যালেঞ্জের মুখে। ট্রাম্পের ভাষ্য অনুযায়ী, বাণিজ্য এবং প্রতিরক্ষা—এই দুই বিষয়কে তিনি আলাদাভাবে দেখছেন না। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় মোতায়েন ২৮,৫০০ মার্কিন সেনার বিনিময়ে আরও বেশি অর্থ দাবি করেছেন এবং একে “বিউটিফুল মিলিটারি প্রটেকশন” বলে অভিহিত করেছেন। অতীতে তিনি এই বাহিনী প্রত্যাহারের হুমকিও দিয়েছিলেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া কৌশল উত্তর কোরিয়ার চেয়ে চীনকে ঘিরে রাখা—এই লক্ষ্যকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, যার ফলে দক্ষিণ কোরিয়াকে নিজের নিরাপত্তার বড় অংশ নিজেকেই বহন করতে হতে পারে।

এ ধরনের পুনর্মূল্যায়নের ফলে কোরিয়া কেবল নিরাপত্তার ঝুঁকিতেই পড়বে না, বরং কূটনৈতিকভাবেও সংকটে পড়বে। লি জে-মিয়ং নিজেই চীন–তাইওয়ান ইস্যুতে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণের পক্ষপাতী। তিনি এক টেলিভিশন বিতর্কে বলেছিলেন, “চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে সংঘর্ষে আমাদের দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। আমরা উভয়ের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রাখতে পারি।” এই অবস্থান মার্কিন কৌশলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।

অন্যদিকে, উত্তর কোরিয়াও নতুন করে আলোচনায় আসছে। ট্রাম্প ও কিম জং উনের সম্ভাব্য দ্বিতীয় দফার বৈঠক দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে, ট্রাম্প তার “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতিতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কিমের সঙ্গে এমন কোনো চুক্তি করে বসবেন, যা কোরিয়ার স্বার্থকে উপেক্ষা করবে। বিশেষজ্ঞ সিডনি সাইলার বলছেন, “এই মুহূর্তে উত্তর কোরিয়া চালকের আসনে। ট্রাম্প যদি শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইসিবিএম বন্ধ করতে চায় এবং দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র উপেক্ষা করে, তাহলে সেটি হবে মারাত্মক ভুল।”

এর মধ্যেই আলোচনায় এসেছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—দক্ষিণ কোরিয়ার শিপবিল্ডিং সক্ষমতা। হায়ুন্দাই হেভি ইন্ডাস্ট্রিজের উলসানের শিপইয়ার্ড বিশ্ববিখ্যাত। দেশটি বছরে ৪০–৫০টি জাহাজ নির্মাণ করে, যার মধ্যে যুদ্ধজাহাজও রয়েছে। কোরিয়া চায়, যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে—তারা শুধু নিরাপত্তায় নয়, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনেও এক নির্ভরযোগ্য অংশীদার। হায়ুন্দাইয়ের নেভাল ইউনিটের প্রধান জিয়ং উ মান বলেন, “আমেরিকার জাহাজ নির্মাণ শিল্পের দুর্বলতা তাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করছে—এটি আমাদের শক্তিশালী তাস।”

বিশ্লেষক ইভান্স রিভিয়ার সতর্ক করে বলেন, “লি, ট্রাম্প ও চীন এই ত্রয়ী মিলে এমন এক জটিলতা তৈরি করছে, যা পূর্ব এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করতে পারে।” ফলে নতুন প্রেসিডেন্টের সামনে এক মুহূর্তও নষ্ট করার সুযোগ নেই। তার প্রথম কাজ হতে পারে ট্রাম্পকে বোঝানো—দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের এক অপরিহার্য কৌশলগত অংশীদার, এবং এই সম্পর্কের মূল্য রয়েছে।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন