শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫

আজ ঠিক হতে পারে শেখ হাসিনার মামলার রায়ের দিন — মানবতাবিরোধী অপরাধে সমাপনী যুক্তি উপস্থাপন করবেন চিফ প্রসিকিউটর ও অ্যাটর্নি জেনারেল

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশত্যাগ করে ভারতে পালানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণার দিন আজ নির্ধারিত হতে পারে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ জানিয়েছে, আজ বৃহস্পতিবার চিফ প্রসিকিউটর ও অ্যাটর্নি জেনারেল সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন করবেন, এরপর আদালত রায়ের তারিখ ঘোষণা করবে।

আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ

বুধবার বিকেলে পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন তিন দিনের যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন। তিনি তাঁর মক্কেলদের নির্দোষ দাবি করে খালাসের আবেদন জানান।

বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে তাঁর যুক্তিতর্ক শোনেন। এসময় তিনি সাক্ষীদের জবানবন্দীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং বলেন,

“এই মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী বলেছেন, শেখ হাসিনা হাসপাতালে গিয়ে বলেছেন ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট’। কিন্তু এমন সংবেদনশীল কথা কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশ না পাওয়াটা অবিশ্বাস্য। তারওপর এই বক্তব্যের পক্ষে কোনো চিকিৎসক বা নার্সের সাক্ষ্যও পাওয়া যায়নি।”

তিনি আরও দাবি করেন, মামলার প্রমাণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপিত ভিডিওগুলোর কিছু কৃত্রিমভাবে (AI দিয়ে) তৈরি এবং বিকৃত তথ্যের ওপর নির্ভর করছে।

প্রসিকিউশন পক্ষ থেকে পাল্টা জবাবে জানানো হয়, সাক্ষ্য ও দালিলিক প্রমাণ যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, এবং আদালতের পর্যবেক্ষণেই দেখা গেছে, আসামিদের নির্দেশে বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়।

প্রসিকিউশনের দণ্ড দাবি

এর আগে ১৬ অক্টোবর পাঁচ দিনের যুক্তি উপস্থাপন শেষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম শেখ হাসিনা ও কামালের সর্বোচ্চ দণ্ড (মৃত্যুদণ্ড) দাবি করেন। তিনি বলেন,

“২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনামল ছিল মানবতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়।”

প্রসিকিউশন পক্ষ মামলার অংশ হিসেবে গুম, হত্যা, পুলিশি নির্যাতন, শাপলা চত্বর ও জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের ঘটনাসহ একাত্তর পরবর্তী রাজনৈতিক নির্যাতনের ধারাবাহিকতা তুলে ধরে।

রাজসাক্ষীর সাক্ষ্য ও আদালতের পর্যবেক্ষণ

এই মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন রাজসাক্ষী হিসেবে আদালতে স্বীকারোক্তি দেন। তাঁর সাক্ষ্যের ওপর প্রসিকিউশন বিশেষ গুরুত্ব দেয়। তবে আসামি পক্ষের আইনজীবী আমির হোসেন যুক্তি দেন, মামুন নিজের শাস্তি এড়াতে সাক্ষ্য দিচ্ছেন।

ট্রাইব্যুনাল বলেন,

“আসামি পক্ষকে নির্দিষ্টভাবে ইনসাইটমেন্ট ও ইন-অ্যাকশন বিষয়ে যুক্তি দিতে হবে; এটি জুডিশিয়াল ইন্টারভেনশন নয়, বরং ন্যায়বিচারের অংশ।”

মামলার প্রেক্ষাপট

২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ মন্তব্যের পর সারা দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, যা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়।

এরপর তাঁর সরকার পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করে।

মামলায় মোট ৮১ জন সাক্ষী, ৮,৭৪৭ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ, ২,০১৮ পৃষ্ঠা তথ্যসূত্র, ৪,০০৫ পৃষ্ঠা জব্দ তালিকা, এবং ২,৭২৪ পৃষ্ঠা শহীদদের বিবরণ আদালতে উপস্থাপিত হয়।

আজ রায়ের দিন ঘোষণার সম্ভাবনা

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে চিফ প্রসিকিউটর ও অ্যাটর্নি জেনারেল তাদের সমাপনী বক্তব্য দেবেন। এরপর ট্রাইব্যুনাল রায়ের তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে নির্ধারণ করবে।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত বিচার প্রক্রিয়া, যার রায় দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক মহলে গভীর আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন