শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫

আজ বিকেলে স্বাক্ষর হচ্ছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’, রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রত্যাশা ও অনিশ্চয়তা একসঙ্গে

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পুনর্গঠনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে এমন ঐতিহাসিক দলিল ‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’ আজ বিকেলে স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিকাল চারটায় অনুষ্ঠেয় এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কমিশন বলছে, এটি হবে “নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিপত্র”, আর প্রধান উপদেষ্টা একে আখ্যা দিয়েছেন “জাতির জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা” হিসেবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ও প্রস্তুতি

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনায় অংশ নেওয়া ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটকে আজকের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে কমিশনের একটি প্রতিনিধি দল এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বেগম খালেদা জিয়ার কাছে আমন্ত্রণপত্র হস্তান্তর করে। তিনি সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের সর্বাঙ্গীন সফলতা কামনা করেন।

তবে সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শেষ মুহূর্তেও মতভিন্নতা কাটেনি। বিশেষ করে গণভোটের সময়সূচি, সংসদের পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি বাস্তবায়ন এবং সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে বিভাজন তৈরি হয়েছে। বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী নভেম্বর মাসে পৃথক গণভোটের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) দাবি তুলেছে, স্বাক্ষরের আগে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দিতে হবে।

বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির ভিন্নমত

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা সনদে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত, তবে আমাদের দেওয়া আপত্তিগুলো যদি চূড়ান্ত কপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।” অপরদিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার জানান, তাদের দল অনুষ্ঠানস্থলে থাকবে কিন্তু এখনো স্বাক্ষর করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। তিনি বলেন, “গণভোট ও নির্বাচনের দিন এক হলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে, তাই নভেম্বরে গণভোট আয়োজনই যুক্তিসঙ্গত।”

এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “আইনি ভিত্তি ছাড়া জুলাই সনদে স্বাক্ষর দেওয়া মানে কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা পালন করা। আমরা চাই, সনদ বাস্তবায়নের আদেশটি আগে জারি করা হোক—তারপরই স্বাক্ষর অর্থবহ হবে।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, “জুলাই ঘোষণাপত্রের সময় যেভাবে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, এবারও সেই আইনি প্রতিশ্রুতি পরিষ্কার নয়।”

বামপন্থী দলগুলোর অবস্থান

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদসহ চারটি বাম দল আজকের অনুষ্ঠানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে তারা অভিযোগ করেছে, তাদের দেওয়া সংশোধনী ও নোট অব ডিসেন্ট যথাযথভাবে চূড়ান্ত সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “চূড়ান্ত সনদে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে—তাই আমরা সই করতে পারি না।”

কমিশনের আশাবাদ ও নিরাপত্তা প্রস্তুতি

অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, অনুষ্ঠানের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন এবং “সব দলের জন্য দরজা খোলা।” তিনি বলেন, “কেউ আজ স্বাক্ষর না করলেও ভবিষ্যতে যোগ দেওয়ার সুযোগ থাকবে। কমিশনের মেয়াদও ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, যাতে বাস্তবায়ন কাঠামো চূড়ান্ত করা যায়।”

এদিকে জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানকে ঘিরে সংসদ ভবন এলাকায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা জারি করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, সংসদ এলাকা ও আশপাশে কোনো ধরনের ড্রোন উড়ানো নিষিদ্ধ থাকবে। অতিরিক্ত পুলিশ ও বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আজকের অনুষ্ঠান শুধু একটি স্বাক্ষর নয়—এটি আগামী সংবিধান সংস্কার ও রাজনৈতিক পুনর্গঠনের দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করবে। তবে সব দল একসঙ্গে সই না করলে এর রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা কতটা শক্ত থাকবে, তা নিয়েই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন