বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫

শ্রীলঙ্কা ভ্রমণে ‘লোকাল’ স্বাদ দিচ্ছে টুকটুক ভাড়া, বদলে দিচ্ছে জীবনের গল্পও

শ্রীলঙ্কার হাইল্যান্ডসের এল্লা থেকে ইউনেস্কো ঘোষিত শহর ক্যান্ডি পর্যন্ত পথচলার স্বপ্ন অনেকেই দেখেন। সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে আঁকাবাঁকা রাস্তা, নীলাভ জলাধার, রাস্তার পাশে সাদা দাড়িওয়ালা বেগুনি মুখের লাঙ্গুর আর হঠাৎ রাস্তায় নেমে আসা হাতি—এই সবই যেন বাস্তবে রূপ নেয় সড়কভ্রমণে। আর সেই ভ্রমণ এখন হয়ে উঠেছে আরও রোমাঞ্চকর ও স্বতন্ত্র, স্থানীয়দের পরিচালিত টুকটুক বা অটোরিকশা চালিয়ে।

এক সময় শুধু যাত্রী হিসেবে টুকটুকে চড়া যেত, তবে ২০১৬ সালে কাটুনায়েক ভিত্তিক স্টার্টআপ TukTuk Rental শ্রীলঙ্কায় পর্যটকদের নিজেই টুকটুক চালানোর সুযোগ এনে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এই উদ্যোগ স্থানীয়দের জীবিকায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

‘টুকটুক’ থেকে বদলে যাচ্ছে জীবন

টুকটুক রেন্টালের বিশেষত্ব হল, তারা স্থানীয় চালকদের কাছ থেকে টুকটুক ভাড়া নেয় এবং তা পর্যটকদের ভাড়া দেয়। এর ফলে এ পর্যন্ত প্রায় ১০০০ শ্রীলঙ্কান পরিবারের কাছে পৌঁছেছে প্রায় ৩০ কোটি রুপি (১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।

এই উদ্যোগের পেছনে ছিলেন অস্ট্রেলীয় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার থমাস করনিশ। ভারতে সাইকেল ভ্রমণের সময় দুর্ঘটনায় পড়ার পর স্থানীয় এক ব্যক্তি তাকে টুকটুক দিয়ে যাত্রা সম্পূর্ণ করতে সহায়তা করেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তার মাথায় আসে পর্যটকদের টুকটুক চালানোর সুযোগ দেওয়ার চিন্তা। সহপ্রতিষ্ঠাতা রিচার্ড ম্যাকিওন এবং উইতসে সেনেমার সঙ্গে মিলে তিনি শ্রীলঙ্কায় শুরু করেন TukTuk Rental।

সেনেমা বলেন, শ্রীলঙ্কায় বহু মানুষ টুকটুক চালান দ্বিতীয় আয়ের উৎস হিসেবে। দিনভর অন্য চাকরির পর সন্ধ্যায় তারা টুকটুক চালিয়ে আয় করেন। এই স্টার্টআপ তাদেরকে ঘরে বসেই আয় করার সুযোগ দিয়েছে।

মাউন্ট লাভিনিয়ার শালিথা সাংকাল্পা তেমনই একজন চালক। আগে দিনে মাত্র ২০০ রুপি আয় করতেন। ২০১৭ সালে নিজের টুকটুক TukTuk Rental-এ যুক্ত করার পর তার আয় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এখন তিনি নিজের গাড়ি কিনেছেন, বাড়িও বানিয়েছেন। এমনকি একদিন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটার জন্টি রোডস তার টুকটুক ভাড়া নিয়ে সমুদ্রতীরের পথে ভ্রমণ করেন। “ওই দিনটা আমার জীবনে বিশেষ এক স্মৃতি হয়ে আছে,” বলেন শালিথা।

পর্যটক, টুকটুক আর স্থানীয়ের গল্প

তবে পর্যটকরা যেন নিরাপদে টুকটুক চালাতে পারে, সেজন্য এগিয়ে আসে সিলন অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন। পর্যটকরা আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট দিয়ে শ্রীলঙ্কার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পারেন, যা TukTuk Rental আগে থেকে তৈরি করে রাখে।

টুকটুক রেন্টালের মাধ্যমে ভ্রমণের নিয়মও সহজ। ওয়েবসাইটে গিয়ে তারিখ, শুরু ও শেষ পয়েন্ট নির্বাচন করলেই বুকিং হয়ে যায়। চাইলে হোটেলে টুকটুক পৌঁছে দেওয়ার এবং ফেরত নেওয়ার সুবিধাও আছে।

এই উদ্যোগ শুধু ভ্রমণ নয়, স্থানীয় অর্থনীতির জন্যও বড় সহায়তা। যেমন চারিথ রাজিন্দ্র, যিনি আগে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন, পরে এয়ারপোর্টে ব্যাগেজ হ্যান্ডলার হিসেবে কাজ করতেন। কোভিডের পর চাকরি কমে গেলে তিনি টুকটুক ভাড়া দিতে শুরু করেন। দুই বছরের মধ্যে গাড়ির লিজ শোধ করে হোমস্টে খুলেছেন। ২০২৪ সালে দ্বিতীয় টুকটুকও কিনে দিয়েছেন TukTuk Rental-এ। “টুকটুক বিদেশিদের কাছে বিলাসী নয়, এটি সাধারণ মানুষের গাড়ি। এটা চালাতে পেরে তারা শ্রীলঙ্কার অন্যরকম স্বাদ পান,” বলেন রাজিন্দ্র।

কানাডার ডায়ানা হিপ্টমেয়ার আর তার স্বামী ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে টুকটুক ভাড়া নিয়ে ২৬ দিনের জন্য দেশ ঘুরেছেন। “ছোট ছোট দোকান, অচেনা গ্রাম আর স্থানীয়দের সঙ্গে মিশতে পেরেছি,” বলেন ডায়ানা। একবার কটুরুটি রান্নায়ও হাত লাগিয়েছেন তার স্বামী ড্যানিয়েল।

ব্রিটেনের কেট ডিকসও টুকটুক রোমাঞ্চে মুগ্ধ। “রাস্তার পাশে বুনো হাতি দেখে আমাদের ডেভিড অ্যাটেনবরোর ডকুমেন্টারির মতো অভিজ্ঞতা হয়েছিল,” বলেন তিনি।

চ্যালেঞ্জের পর এগিয়ে চলা

টুকটুক রেন্টালের পথ অবশ্য কণ্টকমুক্ত ছিল না। ২০১৯ সালের ইস্টার সানডের বোমা হামলা, তার পরের বছর মহামারি পর্যটন কার্যত স্তব্ধ করে দেয়। ধীরে ধীরে আবার পর্যটকরা ফিরতে শুরু করেছেন। এখন ৭৫০ পরিবার এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত।

TukTuk Rental এর সাপ্লায়ার ম্যানেজার ইসুরু ফার্নান্দো বলেন, “আমরা আরেকটি কোম্পানি নয়, ব্যক্তিকে সাপোর্ট করতে চাই।” এ কারণে একটি পরিবার কতগুলো টুকটুক ভাড়া দিতে পারবে, তার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে সংস্থা। যাতে আরও বেশি পরিবার আয় করতে পারে।

সবশেষে, শ্রীলঙ্কার রাস্তা ধরে যখন টুকটুক টলতে টলতে ফিরে যায়, তখন মনে হয়, প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশটি এগিয়ে যাচ্ছে, যেমন এগিয়ে যায় এই ক্ষুদ্র টিনের যান।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন