বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫

বিশ্বকে শীতল রাখার বিপ্লব: ‘রেভল্যুশনারি’ কুলিং প্রযুক্তির সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

এক সময় দিল্লির গ্রীষ্ম মানেই ছিল গরমে হাঁসফাঁস করা। কিন্তু এখন যেন সেই গরম ভয়াবহ তাপদাহে রূপ নিয়েছে। দিল্লির বাসিন্দা স্নেহা সচার, যিনি বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকেন, বলছেন—এই গরম তার শৈশবের চেয়ে অনেক বেশি তীব্র। “গাড়িতে চড়েও স্বস্তি পাই না,” বললেন তিনি।

তবে শুধু শহুরে মানুষ নয়, সবচেয়ে বড় বিপদে পড়ছেন খোলা আকাশের নিচে কাজ করা শ্রমিকরা। স্নেহা বলেন, “তাপদাহ মানুষের জীবন-জীবিকাকে সরাসরি প্রভাবিত করছে।”

বিশ্বজুড়ে মানুষ যে তাপমাত্রার বৃদ্ধির মুখোমুখি হচ্ছে, তা যেন আর স্রেফ ‘গরম’ নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে জীবন-মরণের লড়াই। এ অবস্থায় পৃথিবী জুড়ে শীতলীকরণের চাহিদা যেন আকাশছোঁয়া।

শীতলীকরণের ক্রমবর্ধমান বাজার ও সমস্যা

একটা হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের শীতলীকরণ বাজারের আকার এরই মধ্যে বছরে ২৩৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। আর প্রখ্যাত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান মর্গান স্ট্যানলির পূর্বাভাস—২০৩০ সালের মধ্যে এই বাজারের বার্ষিক বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ হতে পারে।

কিন্তু এয়ারকন্ডিশনিং (এসি) যন্ত্রগুলোর বড় সমস্যা হচ্ছে, এগুলোর ভেতরে থাকা রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস। এই গ্যাস সাধারণত তরল থেকে গ্যাসে পরিবর্তিত হয়ে তাপ স্থানান্তর করে, অর্থাৎ তাপ বের করে দেয়, ঘর ঠাণ্ডা করে। কিন্তু এগুলো প্রায়ই লিক হয়। ফলে একদিকে এগুলো যন্ত্রের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়, অন্যদিকে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

সবচেয়ে বড় বিপদ—এই রেফ্রিজারেন্ট গ্যাসগুলোর অধিকাংশই হাইড্রোফ্লোরোকার্বন (HFC)। এগুলো কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় হাজারগুণ বেশি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই গ্যাসের ব্যবহার কমানোর দিকে এগোচ্ছে।

বিকল্প হিসেবে প্রোপেন, অ্যামোনিয়া বা কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো উপাদান আসছে। কিন্তু প্রোপেন অত্যন্ত দাহ্য, অ্যামোনিয়া বিষাক্ত, আর কার্বন ডাই-অক্সাইডের জন্য উচ্চচাপের যন্ত্রপাতি লাগে, যা ব্যয়বহুল। তাই আপাতত এয়ারকন্ডিশনিংয়ের ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন দ্রুত সম্ভব হচ্ছে না।

স্নেহা সচার বলেন, “বাসাবাড়ির জন্য এসির বিকল্প হয়তো আগামী এক দশকেও পুরোপুরি আসবে না। তাই এখনো রেফ্রিজারেন্টের প্রয়োজন থেকে যাবে।”

নতুন দিগন্তের নাম সলিড-স্টেট কুলিং

তবে বিজ্ঞানীরা এখানেই থেমে নেই। তারা খুঁজছেন এমন এক প্রযুক্তি, যেখানে তরল গ্যাসের পরিবর্তে সলিড-স্টেট কুলিং ব্যবহার করা হবে। এতে কঠিন পদার্থের ওপর চুম্বক, বিদ্যুৎ, চাপ বা যান্ত্রিক টানাপোড়েনের মাধ্যমে তাপমাত্রা পরিবর্তন ঘটানো হয়।

লিন্ডসে রাসমুসেন, যিনি RMI নামের একটি পরিবেশবান্ধব সংস্থায় কাজ করছেন, বলছেন, “সলিড-স্টেট প্রযুক্তি শুধু রেফ্রিজারেন্ট দূর করে না, বরং বিদ্যমান পদ্ধতির চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে।”

RMI এর হিসাব মতে, এমন ১০ থেকে ২০টি স্টার্টআপ এখন এই প্রযুক্তিতে কাজ করছে।

ম্যাগনোথার্ম: চুম্বকের জাদু

জার্মানির ম্যাগনোথার্ম এমনই একটি স্টার্টআপ। তারা ম্যাগনেটোক্যালোরিক কুলিং প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এই প্রযুক্তিতে নির্দিষ্ট ধাতু চুম্বকের প্রভাবে গরম বা ঠাণ্ডা হয়।

ম্যাগনোথার্মের সিইও টিমুর সিরমান বলছেন, “আমাদের প্রযুক্তি নিরাপদ, বিষমুক্ত এবং কম চাপে কাজ করে। চুম্বকই সবচেয়ে ব্যয়বহুল অংশ। তবে সেটি কখনো ভাঙে না, বারবার ব্যবহার করা যায়।”

তারা এখন পর্যন্ত ৪০টি বেভারেজ কুলার এবং পাঁচটি রেফ্রিজারেটর তৈরি করেছে। তবে তাদের পণ্যগুলো এখনো তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল। তাদের মূল ক্রেতা হচ্ছেন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে আগ্রহী গ্রাহকরা।

থার্মোইলেকট্রিক কুলিং: চিপেই ঠাণ্ডার যাদু

আরেকটি সম্ভাবনাময় পদ্ধতি হলো থার্মোইলেকট্রিক কুলিং। এতে বিদ্যুতের মাধ্যমে তাপ একদিক থেকে অন্যদিকে সরানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফোননিক এই প্রযুক্তিতে কাজ করছে।

ফোননিকের সিইও টনি অ্যাটি বলেন, “আমাদের চিপগুলো খুব ছোট, কিন্তু প্রচণ্ড ঠাণ্ডা তৈরি করতে পারে। এগুলো খুব কম বিদ্যুৎ খায়, তবুও কার্যক্ষমতা অনেক বেশি।”

ফোননিকের থার্মোইলেকট্রিক ডিভাইসগুলো এখন ডাটা সেন্টার, সুপারমার্কেটসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে।

এই পদ্ধতির বড় সুবিধা হলো—মেশিন বন্ধ করে রাখা যায়। প্রয়োজনের সময় চালু করা যায়। এতে বিদ্যুৎ, জায়গা এবং খরচ—সব কমে যায়। তাছাড়া এগুলো সম্পূর্ণ নীরব। কোনো মেকানিক্যাল পার্ট নেই বলে শব্দ হয় না।

এলাস্টোক্যালোরিক কুলিং: মেটালের টানেই ঠাণ্ডা

আরও একটি নতুন প্রযুক্তি হলো এলাস্টোক্যালোরিক কুলিং। মেটাল অ্যালয়ের ওপর যান্ত্রিক চাপ প্রয়োগ করলে তাপমাত্রা পরিবর্তন ঘটে। ইউরোপের চারটি দেশের গবেষকরা এ পদ্ধতিতে কাজ করছেন।

এখনো এই পদ্ধতির সক্ষমতা বাণিজ্যিক এসির তুলনায় কম। তবে হংকংয়ের গবেষকরা সম্প্রতি প্রথমবারের মতো ১০০০ ওয়াটের বেশি শীতলীকরণ ক্ষমতা অর্জন করেছে। তারা তাপ সরাতে গ্রাফিন ন্যানোফ্লুইড ব্যবহার করেছে।

চ্যালেঞ্জ রয়ে যাচ্ছে

সলিড-স্টেট ডিভাইসগুলো এখনো প্রচলিত এসির মতো শক্তিশালী নয়। তবু লিন্ডসে রাসমুসেন আশাবাদী, “সময়ের সাথে সাথে কার্যকারিতা এবং খরচ দুটোই কমতে থাকবে।”

তবে বড় প্রশ্ন—এই প্রযুক্তিগুলো কি সেই দেশ বা মানুষের কাছে পৌঁছাবে, যাদের শীতলীকরণের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন? কারণ এখনো এই নতুন ডিভাইসগুলো মূলত ধনী দেশেই সীমাবদ্ধ।

লিন্ডসে বলেন, “সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, এই প্রযুক্তিগুলো কি এমনভাবে তৈরি করা যাবে, যাতে সেগুলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তাপদাহ আক্রান্ত মানুষদের নাগালের মধ্যে আসে?”

ভবিষ্যতের জন্য বিকল্প নেই

বিশ্ব উষ্ণায়নের এই ভয়াবহ সময়ে শীতলীকরণ প্রযুক্তি শুধু বিলাসিতা নয়—এটি হয়ে উঠছে মানুষের টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য এক অস্ত্র। হয়তো আগামী দিনগুলোতে নতুন প্রযুক্তিই হয়ে উঠবে এই লড়াইয়ের বড় ভরসা।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন