শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫

ইরান হামলায় হিরোশিমার তুলনা করলেন ট্রাম্প: “এই আঘাত যুদ্ধ থামিয়েছে”

সম্প্রতি নেদারল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা (ন্যাটো) সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক বিস্ময়কর মন্তব্য করেন, যেখানে তিনি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর মার্কিন ও মিত্রবাহিনীর বিমান হামলার তুলনা করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার সঙ্গে।

তিনি বলেন, “আমি হিরোশিমা বা নাগাসাকির কথা বলছি না, তবে তার মতোই এটি একটি নির্ধারক মুহূর্ত। তারা যুদ্ধ থামিয়ে ছিল, আমরাও থামিয়েছি। এই হামলা প্রয়োজন ছিল। আমরা আঘাত না করলে যুদ্ধ থামত না। আমরাই এটি শেষ করেছি।”

১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক হামলা। ছবি সংগৃহীত

প্রেক্ষাপট: মধ্যপ্রাচ্যের উত্তাল জটিলতা

উল্লেখযোগ্য, গত ১৩ জুন ইসরায়েল সিরিয়ার অভ্যন্তরে অবস্থিত ইরান-সমর্থিত সামরিক ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালিয়ে এই উত্তেজনার সূচনা করে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের বোমারু বিমান থেকে ইরানের অন্তত তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। ২৩ জুন তেহরান মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন ঘাঁটি, কাতারের আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। পরে ২৪ জুন উভয় পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।

যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়

এই সময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মন্তব্য, বিশেষ করে পারমাণবিক আক্রমণের ইতিহাসগত উদাহরণ টেনে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

ট্রাম্পের মন্তব্যের রাজনৈতিক তাৎপর্য

বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এই বক্তব্য মূলত তার রিপাবলিকান ঘাঁটি সমর্থকদের কাছে শক্তি ও সিদ্ধান্তমূলক নেতৃত্বের বার্তা দিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলেও, বৈশ্বিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কাছে এটি উদ্বেগের বার্তা।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. এলেনা ফিল্ড বলেন, “হিরোশিমা-নাগাসাকি ছিল মানব ইতিহাসের ভয়াবহতম একক হত্যাযজ্ঞ। তার সঙ্গে এই আক্রমণের তুলনা করা রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক এবং মানবিক বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য।”

ইরান ও ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া

ইরান সরকার এখনো তাদের ক্ষয়ক্ষতি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করেনি। তবে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, “ইসলামি বিপ্লবের শত্রুরা শিগগিরই তাদের এই ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের জন্য চরম মূল্য দেবে।” অপরদিকে, ইসরায়েল জানায় যে এই হামলা “প্রতিরক্ষামূলক” এবং তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে পরিচালিত হয়েছে।

ইসরায়েলি মিডিয়া হারেতজ এবং টাইমস অব ইসরায়েল জানায়, ইরানীয় ভূখণ্ডে “ডিপ ডুয়াল হিটস” নামক কৌশলে লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামরিক-অভ্যন্তরীণ ডেটা সেন্টার, কমান্ড সেন্টার ও পারমাণবিক গবেষণা ল্যাবগুলোতে আঘাত হানা হয়েছে।

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “আমরা স্পষ্টভাবে বলছি, এই সংঘাত বিশ্বের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। কূটনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া এই সংঘাত নতুন পারমাণবিক দৌড়ে পরিণত হতে পারে।”

এদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন এবং রাশিয়াও যুদ্ধবিরতি স্থায়ী করার আহ্বান জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) সতর্ক করে বলেছে, “পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল এবং এর ফলাফলে পারমাণবিক দূষণ বা বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।”

পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার প্রসঙ্গে বিতর্ক

ট্রাম্পের বক্তব্য নতুন করে ‘পারমাণবিক হামলা বৈধতা’ প্রশ্নে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। হিরোশিমা ও নাগাসাকির ক্ষত এখনো জাপানি জনগণের মধ্যে বয়ে চলেছে। সেই ঐতিহাসিক ঘটনার পুনরাবৃত্তির ইঙ্গিতমূলক বক্তব্য শুধু জাপানের নয়, গোটা এশিয়ার দেশগুলোকেও উদ্বিগ্ন করেছে।

টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ ড. তাকাশি হায়াশি বলেন, “যে কোনো রাষ্ট্রনেতা যদি যুদ্ধ সমাপ্ত করতে পারমাণবিক হামলার উদাহরণ টানেন, তাহলে তা শুধু অপরিণামদর্শিতাই নয়, মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থীও।”

ভবিষ্যতের পথে: শান্তি না সংঘাত?

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ট্রাম্পের এই বক্তব্য হয়তো সুনির্দিষ্টভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এতে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধান নয় বরং উত্তেজনা আরও বাড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র জানান, “বর্তমানে সবচেয়ে জরুরি হলো, উভয় পক্ষকে যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে এবং সংলাপে ফিরিয়ে আনা।”


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন