বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫

জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠান

আসিফ হাসান কাজল

জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানোর স্বপ্ন দেখিয়ে সারাদেশের হাজারো শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কোটি টাকা আদায় করছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। “বাংলাদেশ ক্রিকেট ট্যালেন্ট হান্ট বিডি (পিকেসিএসবিডি)” নামের এই কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের নামে নেওয়া হচ্ছে রেজিস্ট্রেশন ফি, অথচ কার্যকর কোনো প্রতিযোগিতা কিংবা বাছাই কার্যক্রমই নেই।

সূত্র জানায়, চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) শারীরিক শিক্ষা বিভাগ এক অফিসিয়াল চিঠির মাধ্যমে ‘ক্রিকেট ট্যালেন্ট হান্ট ২য় পর্ব ২০২৫’ নামে কার্যক্রম বাস্তবায়নে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়। চিঠিতে বলা হয়, প্রতিযোগিতা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সমন্বয় ও সহায়তা প্রদান করতে হবে। তবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল, এ কার্যক্রমে শিক্ষার্থী কিংবা মাউশির কোনো আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকবে না।

তথ্য গোপন রেখে অর্থ আদায়

প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শিক্ষার্থীদের জন্য ২০০ টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। বয়সসীমা ধরা হয়েছে ১২ থেকে ২২ বছর। অংশগ্রহণকারীদের দেওয়া হচ্ছে অনলাইন ‘এন্ট্রি টিকিট’, ‘সার্টিফিকেট’ ও অ্যাডমিট কার্ড। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মো. সৈকতের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, “সরকারি একটি চিঠিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি মাঠপর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে টাকা তুলছে। শিক্ষার্থীরা প্রতারণার শিকার হচ্ছে, অথচ সরকারি কোনো মনিটরিং কার্যকরভাবে নেই।”

‘বাছাইয়ের নামে লোক দেখানো আয়োজন’

গত বছরও প্রতিষ্ঠানটি একই ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে হাজারো শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ফি নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তখনও উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিযোগিতা হয়নি। কেবল ঢাকার উত্তরার দুটি মাঠে নামমাত্র অনুশীলন করিয়ে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখা হয়। নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের কোনো তালিকা কিংবা ভবিষ্যৎ কার্যক্রম সম্পর্কে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, “শিশু-কিশোর বয়সে এমন প্রতারণা তাদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখিয়ে হতাশ করা নিঃসন্দেহে প্রতারণার শামিল।”

নতুন কর্মকর্তার মন্তব্য: ‘আর কাজ দেওয়া হবে না’

এ বিষয়ে মাউশির শারীরিক শিক্ষা বিভাগের উপপরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, “আমি নতুন দায়িত্ব পেয়েছি, পূর্বের কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টিও জানা ছিল না। ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠানকে আর কোনো কাজ দেওয়া হবে না।”

তিনি আরও বলেন, “প্রথমবার তারা জানিয়েছিল, করোনার কারণে কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। এবার সাড়া কম থাকায় আপত্তি করিনি। তবে এখন যেভাবে অর্থ আদায় হচ্ছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।”

শিক্ষকদের বাধ্যবাধকতা, শিক্ষার্থীদের হতাশা

সরকারি নির্দেশনার আলোকে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত ৩টি গ্রুপে (ষষ্ঠ-সপ্তম, অষ্টম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ) ১১ জন করে শিক্ষার্থীকে অংশ নিতে বলা হয়েছে। শিক্ষকরা বলছেন, “এটি বাধ্যতামূলক রূপে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ শিক্ষার্থীরা কোথাও গিয়ে প্রতিদান পাচ্ছে না। এতে স্কুলের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”

চলছে অনলাইন নিবন্ধন, বাড়ছে প্রতারণার পরিসর

চলতি বছর ২০ এপ্রিল থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত অনলাইনে নিবন্ধনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রত্যেক স্কুল থেকে গড়ে ১১ জন অংশ নিলে রেজিস্ট্রেশন ফি থেকেই প্রতিষ্ঠানটির আয় কোটি টাকার ঘরে পৌঁছায়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শিগগিরই বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হতে পারে।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন