শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫

ইসরায়েলের অবরোধে বিপর্যস্ত পশ্চিম তীর: বন্দী জীবন, গুলি, গ্যাস ও মানবিক সংকট

ইরানের সঙ্গে সামরিক সংঘাতে জড়ানোর মধ্যেই ইসরায়েল পশ্চিম তীরজুড়ে কঠোর অবরোধ জারি করেছে। সেনাবাহিনী তিন দিন ধরে শহর ও গ্রামগুলোর প্রবেশপথ বন্ধ করে দিয়েছে লোহার গেট ও কংক্রিটের দেয়াল দিয়ে। বসানো হয়েছে শত শত চেকপয়েন্ট, বাড়ানো হয়েছে সেনা উপস্থিতি। জাতিসংঘের হিসাবে, ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া গাজা যুদ্ধের পর এ পর্যন্ত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ৯৪৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন—এর মধ্যে ২০০-এর বেশি শিশু।

বন্দী নগরী, বাধা অ্যাম্বুলেন্সেও

আল জাজিরার প্রতিবেদক নিদা ইব্রাহিম জানিয়েছেন, ইসরায়েলি সেনারা এখন রামাল্লা, এল-বিরেহ, নাবলুস, হেবরন, ক্যালকিলিয়া ও জর্ডান উপত্যকাসহ বিভিন্ন শহরে প্রবেশ ও বাহিরের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। চেকপয়েন্টে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থাকছে সাধারণ মানুষ এমনকি অ্যাম্বুলেন্সও।

এক অ্যাম্বুলেন্স চালক ফায়েজ আবদেল জাব্বার বলেন,

“চেকপয়েন্ট পেরোতে কখনো কখনো ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে—এমনকি মিলিটারি পারমিশন নিয়েও। এক নারী রোগী আজ ভোরে তিন ঘণ্টা আটকে ছিলেন। এখন আমাদের রোগী এক অ্যাম্বুলেন্স থেকে আরেক অ্যাম্বুলেন্সে হস্তান্তর করেই চলতে হচ্ছে।”

এছাড়া তুলকারেম শরণার্থী ক্যাম্পে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরকে গুলি করে আহত করেছে সেনারা। অন্তত ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে রাতে হানা দিয়ে।

বসতিতে বসতি: সেনারা বাড়ি দখল করে বসিয়েছে ঘাঁটি

ওয়াফা নিউজ এজেন্সির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনারা অনেক ফিলিস্তিনিকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে সেই ঘরগুলোকে সামরিক চৌকিতে পরিণত করেছে। কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে পারছেন না, জীবিকা কার্যত থেমে গেছে।

‘অবরোধ নয়, এটা দখলের কৌশল’

পিএলও’র (PLO) সেটেলমেন্ট ইউনিটের কর্মকর্তা কাসিম আওয়াদ বলেন,

“৭ অক্টোবর ২০২৩-এর পর থেকে ইসরায়েল পশ্চিম তীরে চেকপয়েন্ট ও ব্যারিকেডের সংখ্যা ৬০০ থেকে বাড়িয়ে ৯০০ করেছে। এখন ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের সুযোগে আরও অবরোধ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে—ফিলিস্তিনিদের একেকটি বিচ্ছিন্ন ঘেটোতে পরিণত করা হচ্ছে।”

জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতরের মার্চ মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০২৪ সালজুড়ে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েল বসতি সম্প্রসারণ ও সংযুক্তিকরণ তৎপরতা বাড়িয়েছে। এখন ইরানের সঙ্গে চলমান সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে পশ্চিম তীরকে আরও বেশি দমন করার আশঙ্কা বাড়ছে।

দখলের ডাক: ইসরায়েলি মন্ত্রীরা চায় পশ্চিম তীর, গাজা, এমনকি লেবানন-সিরিয়া!

গত বৃহস্পতিবার সডেরট শহরে এক সম্মেলনে ইসরায়েলি মন্ত্রীদের প্রকাশ্য ঘোষণা ছিল: “আমরা পশ্চিম তীর চাই, গাজা চাই, লেবানন চাই, সিরিয়া চাই!”—এমন বক্তব্য দেন হেরিটেজ মন্ত্রী আমিখাই এলিয়াহু। এতে সাড়া দিয়ে উপস্থিত জনতাও সমর্থন জানায়।

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের ছায়ায় আহত ফিলিস্তিনিরা

ইরান ও ইসরায়েল পরস্পরের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর, প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ছিন্নাংশ পশ্চিম তীরে পড়ে বহু ফিলিস্তিনিকে আহত করেছে। যেহেতু এখানে কোনো বোমাশেল্টার নেই, ফিলিস্তিনিরা উন্মুক্ত আগুনের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন।

ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েল জুড়ে ব‍্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়

আন্তর্জাতিক নীরবতা ও মানবাধিকার প্রশ্ন

জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা (UNRWA) এক বিবৃতিতে বলেছে,

“পশ্চিম তীর কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নয়। এটি আন্তর্জাতিক আইনের আওতাভুক্ত একটি প্রশাসনিক এলাকা—যেখানে আইন প্রয়োগকারী বাহিনী মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত, নিপীড়নের নয়।”

ইউএনআরডব্লিউএ’র পশ্চিম তীর বিষয়ক পরিচালক রোল্যান্ড ফ্রিডরিখ বলেন,

“আইন-শৃঙ্খলা প্রয়োগের অর্থ হওয়া উচিত দুর্বলদের সুরক্ষা, তাদের ক্ষতি নয়। এবং সর্বোপরি—মানবিক মর্যাদা ও জীবন রক্ষা করা।”


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন