শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫

ইসরায়েলের বৈশ্বিক বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ছে? পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় প্রযুক্তি ও হীরা-নির্ভর অর্থনীতি ঝুঁকিতে

২৩ মে ২০২৫ | সূত্র: আল জাজিরা, রয়টার্স, UN Comtrade

গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান এবং পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি সম্প্রসারণের অভিযোগে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এখন সরাসরি বাণিজ্যে ধাক্কা দিচ্ছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য ইসরায়েলের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করেছে। পাশাপাশি অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাদের বিদ্যমান বাণিজ্য সহযোগিতা চুক্তি পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফ্রান্স ও কানাডাও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলো ইসরায়েলের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিকে গভীর চাপে ফেলেছে।

ইসরায়েল মূলত উচ্চপ্রযুক্তি পণ্য, সামরিক ইলেকট্রনিকস, ওষুধ এবং হীরা প্রক্রিয়াজাতকরণে বিশ্ববাণিজ্যে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছিল। তবে পশ্চিমা বিশ্ব যখন তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে শুরু করেছে, তখন প্রশ্ন উঠছে—এই অর্থনীতি টিকবে কতদিন?

ইসরায়েলের রপ্তানির চালিকাশক্তি কী

২০২৪ সালে ইসরায়েল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৬ হাজার ১৭০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ছিল উচ্চপ্রযুক্তি ও ইলেকট্রনিকস খাতে, যেখানে প্রধান ভূমিকায় রয়েছে ইনটেল, এলবিত সিস্টেমস ও অরবোটেক। ওষুধ রপ্তানিতে অন্যতম প্রধান নাম টেভা ফার্মাসিউটিক্যালস। পাশাপাশি হীরা আমদানি করে পালিশ ও প্রক্রিয়াজাত করে আবার রপ্তানির মাধ্যমে গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী হীরা ইন্ডাস্ট্রি।

রপ্তানিকৃত প্রধান পণ্যের তালিকায় ছিল প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ, ১ হাজার কোটি ডলারের ওষুধ ও রাসায়নিক, ৯০০ কোটি ডলারের হীরা ও গয়না, ৭০০ কোটি ডলারের চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ৫০০ কোটি ডলারের খনিজদ্রব্য।

ইসরায়েলি পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা কারা

যুক্তরাষ্ট্র ছিল ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য, যেখানে ২০২৪ সালে ১ হাজার ৭৩০ কোটি ডলারের পণ্য গেছে। এদের মধ্যে ছিল হীরা, চিপসেট, টেলিকম যন্ত্রপাতি এবং সামরিক উপাদান। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল আয়ারল্যান্ড, যেখান থেকে ৩০০ কোটি ডলারের ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট রপ্তানি করা হয়। এরপর চীন, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ভারত, ফ্রান্স, ইতালি, ব্রাজিল ও জাপানসহ আরও অন্তত ১৫টি দেশ ইসরায়েলি পণ্যের উল্লেখযোগ্য আমদানিকারক।

বিজ্ঞাপন

ইসরায়েলের প্রধান আমদানিকারক দেশগুলো

২০২৪ সালে ইসরায়েল আমদানি করেছে প্রায় ৯ হাজার ১৫০ কোটি ডলারের পণ্য। চীন ছিল সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ, যার মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য ইসরায়েলে প্রবেশ করেছে। চীন থেকে এসেছে বৈদ্যুতিক গাড়ি, মুঠোফোন, কম্পিউটার এবং বিভিন্ন ধাতব উপাদান। যুক্তরাষ্ট্র ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম, যার রপ্তানির পরিমাণ ৯৪০ কোটি ডলার। এতে ছিল অস্ত্র, বিস্ফোরক, প্রযুক্তি সরঞ্জাম এবং হীরা।

তৃতীয় অবস্থানে ছিল জার্মানি, যাদের রপ্তানি ছিল ৫৬০ কোটি ডলার। এই রপ্তানির মধ্যে ছিল গাড়ি, ওষুধ, যন্ত্রপাতি ও ইলেকট্রনিক উপাদান। অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রপ্তানিকারক ছিল ইতালি (৩৬২ কোটি), তুরস্ক (২৮৬ কোটি), ফ্রান্স (২২০ কোটি), ভারত (২০৭ কোটি), জাপান (১৯৪ কোটি) এবং দক্ষিণ কোরিয়া (২১৫ কোটি)।

নিষেধাজ্ঞার সম্ভাব্য প্রভাব কী

বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের চলমান নিষেধাজ্ঞা ইসরায়েলের সবচেয়ে লাভজনক বাজারগুলোতে রপ্তানি ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। এতে বিশেষ করে ইসরায়েলের প্রযুক্তি ও ওষুধ খাতে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ইউরোপীয় ফার্মাসিউটিক্যাল বাজারে টেভা ফার্মাসিউটিক্যালসের পণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী ওষুধ সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে, হীরা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা এলে ভারত ও বেলজিয়ামের হীরা প্রক্রিয়াজাত শিল্প নতুন সুবিধা পেতে পারে।

এছাড়া প্রযুক্তি খাতে নিষেধাজ্ঞার ফলে চিপ ও মাইক্রোপ্রসেসর রপ্তানিতে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। পশ্চিমা টেক কোম্পানিরা নিরাপত্তা ও মানবাধিকার উদ্বেগে ইসরায়েলের সঙ্গে অংশীদারিত্ব সীমিত করতে পারে।

নতুন বাণিজ্যিক কৌশলের দিকে ঝুঁকছে ইসরায়েল

এই সংকটময় সময়ে ইসরায়েল সম্ভবত এশিয়ার বাজারে বাণিজ্যিক কৌশল পুনর্গঠন করতে পারে। চীন, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও গভীর করার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। তবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও কূটনৈতিক চাপ ইসরায়েলের নতুন বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের পথেও বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

ইসরায়েলের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি এখন এক কঠিন মোড়ে দাঁড়িয়ে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে দেশের প্রযুক্তি, ওষুধ ও হীরা বাণিজ্য বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে। শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, এ নিষেধাজ্ঞা ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক অবস্থান, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং বিনিয়োগ পরিবেশকেও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দেখার বিষয়—ইসরায়েল এই বৈশ্বিক চাপ মোকাবিলায় কী ধরনের কৌশল গ্রহণ করে।

বিজ্ঞাপন


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন