বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫

ইসলামে হিংসা: একটি আত্মিক ব্যাধির গভীর বিশ্লেষণ

ইসলামের মূল ভিত্তি শান্তি, ন্যায়বিচার ও আত্মিক পরিশুদ্ধি। এই ধর্ম ব্যক্তি ও সমাজকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। ইসলাম মানুষের চিন্তা, আচরণ ও অন্তরজগতকে বিশুদ্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। তাই ইসলাম শুধু বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানায় না, বরং অন্তরের অভ্যন্তরীণ রোগ ও দুর্বলতাগুলোকেও গুরুত্বসহকারে চিহ্নিত করে। তেমনি একটি আত্মিক ব্যাধি হলো হিংসা (হাসাদ)—যা ঈমান, সম্পর্ক ও নৈতিকতা ধ্বংসের একটি মূল উপাদান।


হিংসা কী? (সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ)

আরবি শব্দ “হাসাদ” অর্থ:

“অন্যের প্রাপ্ত ভালো বা নিয়ামতের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তা নিজের জন্য কামনা না করে বরং সে যেন তা হারিয়ে ফেলে—এই আকাঙ্ক্ষা করা।”

হিংসার দুইটি রূপ রয়েছে:

  1. হারিয়ে যাওয়ার কামনা: অন্যের প্রাপ্ত ভালো কিছু সে যেন হারিয়ে ফেলে—এই মন্দ ইচ্ছা পোষণ করা।
  2. সদৃশ্য পাওয়ার ইচ্ছা (গিবতা): অন্য যা পেয়েছে, আমি যেন তাও পাই—এই কামনা (যেটা নিন্দনীয় নয়)। রাসূল (সা.) এই ধরনের হিংসাকে “হাসাদে মাহমুদা” বলে ব্যাখ্যা করেছেন।

কুরআনে হিংসার কঠোর নিন্দা

হিংসার বিরুদ্ধে আল্লাহ তাআলা সরাসরি সতর্ক করেছেন। হিংসাকে শয়তানের অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

❖ সূরা ফালাক (১১৩:৫)

“وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ”
“হিংসুক যখন হিংসা করে, তখন তার অনিষ্ট থেকে আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি।”

ব্যাখ্যা: এই আয়াতটি আল্লাহর কাছ থেকে সরাসরি একটি রক্ষা প্রার্থনার শিক্ষা দেয়। এতে বোঝা যায়, হিংসা এমন এক অন্তর্জাত আগুন যা ব্যক্তির জন্য যেমন ধ্বংসাত্মক, তেমনি সমাজের জন্য ভয়ানক বিভাজন তৈরি করে।

❖ সূরা নিসা (৪:৫৪)

“তারা কি ঈর্ষা করে তাদের প্রতি, যাদেরকে আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ দান করেছেন?”

ব্যাখ্যা: এখানে হিংসাকে আল্লাহর ফয়সালায় অসন্তুষ্টি প্রকাশের মতো ভয়ানক অপরাধ বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কারণ আল্লাহ যাকে যা দেন, তা তাঁর জ্ঞানের আলোকে নির্ধারিত।


হাদীসে হিংসার ভয়াবহতা

হাদীসে হিংসাকে “দ্বীন ধ্বংসকারী আগুন” বলে অভিহিত করা হয়েছে।

❖ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:

“হিংসা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা হিংসা নেক আমলকে আগুনের মতো ধ্বংস করে দেয়, যেমন আগুন শুকনো কাঠ পুড়িয়ে ফেলে।”
— (আবু দাউদ, হাদীস ৪৯০৩)

ব্যাখ্যা: হিংসা ব্যক্তির আমল ও ইবাদতের ভিতর থেকে সব নেকি শুষে নেয়। একজন হিংসুক ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে ইবাদত করলেও, তার অন্তর অপবিত্র থাকলে সেই ইবাদতের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

❖ রাসূল (সা.) আরও বলেন:

“তোমরা পরস্পরের প্রতি হিংসা করো না, বিদ্বেষ রেখো না, প্রতিযোগিতা করে সম্পর্ক ছিন্ন করো না এবং একে অপরের পিঠ ফিরিয়ে নিয়ো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে থাকো।”
— (সহীহ মুসলিম)

ব্যাখ্যা: এই হাদীসে হিংসাকে সমাজিক সম্পর্কবিনাশী এক মারাত্মক রোগ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ইসলাম ভ্রাতৃত্বের ধর্ম—যেখানে একজন মুমিনের আনন্দে অপর মুমিনের খুশি হওয়াই কাম্য।


হিংসার কারণ ও মনস্তত্ত্ব

হিংসা মূলত ব্যক্তির আত্মিক দুর্বলতা ও ঈমানের ঘাটতির ফল। এর উৎস হতে পারে—

  • অহংকার: “আমি কেন পাইনি?”
  • কৃপণতা: “ওরটা আমার হওয়া উচিত ছিল।”
  • আত্মতুষ্টির অভাব: “সে ভালো আছে, আমি কেন কষ্টে?”
  • আল্লাহর তাকদিরে অসন্তুষ্টি।

ইমাম গায্জালি (রহ.) বলেন:
“হিংসা হলো এমন একটি ব্যাধি, যা ব্যক্তির আত্মাকে প্রথমে ব্যতিব্যস্ত করে, এরপর তার আমলকে নষ্ট করে, তারপর সমাজের বন্ধন ছিন্ন করে।”


হিংসার পরিণতি

  1. আত্মিক ধ্বংস: হিংসুক ব্যক্তি সবসময় জ্বলে-পুড়ে মরে, কখনো শান্তি পায় না।
  2. সামাজিক বিভাজন: হিংসা থেকে অপবাদ, গীবত, হানাহানি ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়।
  3. আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত: হিংসুক ব্যক্তি নিজের জন্যও দোয়া কবুলে বাধা তৈরি করে।
  4. পাপের চক্রে পতন: হিংসা থেকে অনেক সময় হত্যা, চুরি, দখল, অবিচার ইত্যাদি অপরাধের জন্ম হয়।

কিভাবে হিংসা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়

  1. আল্লাহর তাকদিরে সন্তুষ্ট থাকা
    ঈমান রাখা: “যে যা পেয়েছে, তা আল্লাহর ইচ্ছায়—তাতে আমার ক্ষতি নেই।”
  2. শুকরিয়া আদায়
    নিজের নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
  3. গিবতায় রূপান্তর
    হিংসার বদলে ‘ইচ্ছা করি, আমি যেন ওর মতো ভালো হই’—এই চেতনা লালন করা।
  4. প্রতিদিনের দোয়া পাঠ
    কুরআনের সূরা ফালাক নিয়মিত পাঠ করলে হিংসার অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
  5. আত্মবিশ্লেষণ ও তওবা
    অন্তর বিশুদ্ধ রাখতে নিয়মিত তাওবা এবং আত্মসমালোচনার অভ্যাস গড়ে তোলা।

উপসংহার

ইসলাম হিংসাকে একটি আত্মঘাতী আগুন হিসেবে দেখে, যা সর্বপ্রথম হিংসুক ব্যক্তিকেই গ্রাস করে। এই চারিত্রিক দোষ একজন মানুষের আত্মাকে কলুষিত করে, সমাজকে বিভক্ত করে এবং ন্যায়পরায়ণতাকে বিপন্ন করে তোলে। একজন প্রকৃত মুসলমান কখনো হিংসুক হতে পারে না। বরং সে নিজে কৃতজ্ঞ, অন্যের ভালো দেখে আনন্দিত এবং প্রয়োজনে দোয়া করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু ঈমানের পূর্ণতা নয়, একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের পূর্বশর্তও বটে।



এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন