বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫

ইহুদি রাষ্ট্র ৮০ বছরের বেশি টিকে না—ধারণার উৎস, ধর্মীয় ইঙ্গিত, ইতিহাস ও সমসাময়িক বিশ্লেষণ

“ইহুদি রাষ্ট্র ৮০ বছরের বেশি টিকে না”—সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত, ফিলিস্তিন সংকট এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত ও বিতর্কিত এই তত্ত্বটি আবার সামনে চলে এসেছে। কেউ একে ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে বিবেচনা করছেন, কেউ বলছেন ধর্মীয় ইঙ্গিত, আবার কেউ এটিকে ঐতিহাসিক চক্র বলে আখ্যায়িত করছেন। এই প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করা হলো এই দাবির ঐতিহাসিক ভিত্তি, ধর্মীয় ব্যাখ্যা, সমসাময়িক প্রেক্ষাপট এবং বিভিন্ন বিশ্লেষকের মতামত।

ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক ব্যাকগ্রাউন্ড

এই ধারণার ভিত্তি মূলত দুটি প্রাচীন ইহুদি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সময়কাল থেকে উঠে এসেছে। প্রথমটি ছিল রাজা দাউদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ইসরায়েল রাজ্য, যা টিকে ছিল প্রায় ৮০ বছর (খ্রিস্টপূর্ব ১০২0–৯২২)। দ্বিতীয়টি ছিল পারসিয়ান সম্রাট কোরেশ কর্তৃক অনুমতিপ্রাপ্ত পুনর্গঠিত ইহুদি রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯–৭০ খ্রিস্টাব্দ)। এই দুই রাষ্ট্রই যুদ্ধ, ব্যর্থতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে প্রায় একই মেয়াদে বিলুপ্ত হয়। এই ইতিহাসই বহু ধর্মবিশ্বাসী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ধারণা জন্ম দেয় যে, আধুনিক ইসরায়েলও একটি চক্রের অংশ এবং সেটির আয়ুষ্কাল ৮০ বছর।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ২০২৮ সালে ৮০ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে। এই সময়কাল ঘিরেই অনেকে আশঙ্কা ও প্রত্যাশা প্রকাশ করছেন।

কুরআন ও বাইবেলের ইঙ্গিত

ইসলাম ধর্মে বনি ইসরাইল সম্পর্কে কুরআনের সূরা বনী ইসরাইলে (আয়াত ৪–৮) বলা হয়—

“দুইবার তারা (বনী ইসরাইল) দুনিয়ায় ফাসাদ সৃষ্টি করবে, আর দুইবারই আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর জাতিকে পাঠাবেন।”

অনেক আলেম মনে করেন, আধুনিক ইসরায়েল রাষ্ট্রই সেই দ্বিতীয় “ফাসাদ” যুগ, এবং এর পতন অবশ্যম্ভাবী। শায়খ ইমরান হোসেইন নামের বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ বারবার তার বক্তৃতায় এই “৮০ বছর থিওরি”-কে কোরআনের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন এবং ২০২৮ সালের মধ্যে ইসরায়েলের পতন হবে বলে মত দিয়েছেন।

অন্যদিকে ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তোরাহ ও খ্রিস্টান বাইবেলেও ‘অন্যায়কারী জাতির উপর পতনের হুমকি’ বারবার এসেছে। তবে সেখানে সময়সীমা নির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি।

রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বাস্তবতা

যদিও এই তত্ত্ব ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক সূত্রে বিশ্লেষিত হচ্ছে, বাস্তবতা বলছে ইসরায়েল এখন বিশ্বের অন্যতম সামরিক পরাশক্তি। পারমাণবিক অস্ত্র, উন্নত গোয়েন্দা সংস্থা (মোসাদ), আমেরিকা ও ইউরোপীয় মিত্রদের সমর্থন তাকে এই মুহূর্তে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে। ২০২৩ সালে গাজায় হামলার পর যদিও ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ে, তথাপি পশ্চিমা জোট তার পক্ষে অবস্থান নেয়।

তবে ইসরায়েলি সমাজে অভ্যন্তরীণ বিভাজনও বড় একটি চ্যালেঞ্জ। চরম ডানপন্থী সরকারের আগ্রাসী নীতি, অভ্যন্তরীণ ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মীয় বিভক্তি, ফিলিস্তিন দখল প্রশ্নে আন্তর্জাতিক চাপ এবং বারবার সংঘর্ষ ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

বিশ্লেষকদের মতামত

বিশিষ্ট ইসলামি স্কলার ড. হায়াৎুল্লাহ কাসেমী মনে করেন, “আল্লাহর দেওয়া সময়সীমা যখন শেষ হয়, তখন ধ্বংস আসে নিশ্চিতভাবে। আজকের ইসরায়েল অবিচার, দখল, হত্যাযজ্ঞে জড়িত। ইতিহাস বলে, এমন অন্যায়কারী শক্তি দীর্ঘস্থায়ী হয় না।”

অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদ জামান বলেন, “৮০ বছর একটি প্রতীকী সংখ্যা হতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র ঐতিহাসিক সময়কাল দিয়ে ভবিষ্যৎ রাজনীতির পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়। তবু ইতিহাস বলে—সব সাম্রাজ্যই পতনের দিকে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, কবে, কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায়।”

ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ইয়োভাল হ্যারারি এক বক্তব্যে বলেন, “ইহুদি জাতি হাজার বছর টিকে থাকার অনন্য দৃষ্টান্ত। তবে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল টিকে থাকার জন্য কেবল সামরিক শক্তি নয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও অভ্যন্তরীণ ঐক্য জরুরি।”

ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ ও ৮০ বছর থিওরি

ফিলিস্তিনিদের মধ্যে এই ধারণাটি উৎসাহের উৎস হয়ে উঠেছে। হামাস ও ইসলামি জিহাদের নেতারা প্রায়ই তাদের বক্তব্যে “ইসরায়েলের পতন ঘনিয়ে এসেছে” বলেই দাবি করছেন। ২০২৩ সালের যুদ্ধের সময় হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া বলেন, “ইসরায়েল এখন তার অস্তিত্বের সংকটে। এটি একটি পতনশীল সাম্রাজ্য।”

উপসংহার

“৮০ বছর তত্ত্ব” নিছক একটি ধর্মীয় বা ঐতিহাসিক কল্পনা নয়; এটি একটি গভীর সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং মানসিক প্রতিচ্ছবি। বিশ্বাস, প্রতিরোধ এবং ভবিষ্যতের আশঙ্কা মিলিয়ে এটি এক ধরণের প্রতীক হয়ে উঠেছে। যদিও এর ভবিষ্যত নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব ও জনগণের চেতনার উপর, তবু ২০২৮ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা এই ধারণাটিকে আরো প্রাসঙ্গিক এবং বিতর্কিত করে তুলবে।

ইতিহাস বলছে, কোনো রাষ্ট্রই চিরস্থায়ী নয়। আর বিশ্বাস বলছে, অবিচার কখনও চিরকাল টেকে না। ৮০ বছর পার হলে, বিশ্ব দেখবে—ইসরায়েল তৃতীয়বারের মতো কি টিকতে পারে, নাকি ইতিহাস আবারো পুনরাবৃত্ত হয়।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন