বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫

সম্পাদকীয়: মাস্কের ‘আমেরিকা পার্টি’ — প্রযুক্তি ও পুঁজির রাজনৈতিক উচ্চারণ

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রযুক্তির একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম ও তথ্যনিয়ন্ত্রণের মধ্যেই। এবার সেই আধিপত্য সরাসরি রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ নিচ্ছে, ইলন মাস্কের ‘দ্য আমেরিকা পার্টি’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এটি নিছক ‘জনমত যাচাই’ নয়, বরং দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় গভীর অসন্তুষ্টির চিত্র।

ইলন মাস্ক এমন একজন ব্যক্তি, যিনি রাষ্ট্র নয়—পর্যবেক্ষণ, ধাক্কা এবং বিতর্ক দিয়ে নিয়ত ক্ষমতা কাঠামোতে হস্তক্ষেপ করে আসছেন। এবার তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘর্ষে জড়িয়ে নিজের রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়ে সরাসরি প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে বসালেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এটি আসলেই রাজনৈতিক বিকল্প তৈরির প্রচেষ্টা, না কি একজন ধনকুবেরের অভিমানজনিত পাল্টা শক্তি-প্রদর্শন?

মাস্কের অনলাইন ভোটে ৮০ শতাংশ মানুষ নতুন রাজনৈতিক দলের পক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু এই সংখ্যা বাস্তব রাজনীতিতে ভোটে রূপান্তরিত হবে কি না, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বহু স্বাধীন প্রার্থী বা তৃতীয় শক্তির দল উদিত হলেও তারা শেষ পর্যন্ত গুটি কয়েক রাজ্য ছাড়া প্রভাব ফেলতে পারেনি। কারণ, দেশটির সংবিধানিক কাঠামো ও নির্বাচন ব্যবস্থা প্রকারান্তরে দুই দলের শ্রেণিকেই প্রাধান্য দেয়।

তবুও মাস্কের রাজনৈতিক অভিলাষকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। তিনি একাধারে প্রযুক্তির অগ্রপথিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিয়ন্ত্রক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে—পুঁজির দেবদূত। তাঁর রয়েছে এমন একটি ফ্যানবেস, যারা রাজনীতিকদের চেয়ে বেশি তাকে বিশ্বাস করে। এটি মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য যেমন নতুন পরীক্ষার মুখ, তেমনি একটি অন্তর্নিহিত বিপদও বয়ে আনছে—রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা যদি সরাসরি কর্পোরেট নেতৃত্বের হাতে যায়, তবে গণতন্ত্রের চেহারা কী থাকবে?

এখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সংঘর্ষকেও নিছক ব্যক্তি দ্বন্দ্ব মনে করার সুযোগ নেই। এটি দুই ধরনের ডানপন্থী শক্তির সংঘর্ষ: একদিকে জাতিবাদী, রক্ষণশীল ও রাজনৈতিক চাতুর্য নির্ভর ট্রাম্প, অন্যদিকে প্রযুক্তি-নির্ভর আধুনিকতাবাদী, ব্যয়-সচেতন ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক মাস্ক। এ সংঘর্ষ আগামী নির্বাচনে রিপাবলিকান ঘরানায় বিভাজন ডেকে আনতে পারে, যার ফলে ডেমোক্র্যাটদের পাল্লা ভারী হয়ে ওঠার আশঙ্কাও জোরালো।

আরেকটি বড় প্রশ্ন, মাস্ক যদি সত্যিই ‘আমেরিকা পার্টি’ নিয়ে এগিয়ে যান, তবে তিনি কি শুধু ট্রাম্প-বিরোধী ভোট নেবেন, নাকি প্রতিষ্ঠানবিরোধী এক সার্বজনীন সমর্থন তৈরি করতে পারবেন? তার প্রযুক্তিপ্রেমী সমর্থকরা কি ভোটার হিসেবে মাঠে নামবেন?

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি এখন যে চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে, সেখানে মাস্কের এই পদক্ষেপ ‘হাস্যকর কৌশল’ না হয়ে উঠতে পারে এক পলিটেকনো-ফিউচারিজমের সূচনা। এক সময়ের কর্পোরেট সিইও যদি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়ে ওঠেন, তবে গণতন্ত্রের ধারণা, জনগণের প্রতিনিধিত্ব এবং রাষ্ট্রীয় নীতির কেন্দ্রবিন্দু পুরোটাই নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হতে পারে।

আমরা মাস্কের উদ্যোগকে হঠাৎ আবেগ বা হুমকির ভাষায় পর্যালোচনা না করে, এটিকে গভীর সামাজিক ও কাঠামোগত বাস্তবতা হিসেবে মূল্যায়ন করতে চাই। এটি মার্কিন সমাজের মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক মানুষের হতাশা, রাজনৈতিক বিভাজন এবং পুঁজিবাদী উদারনৈতিক গঠনের ওপর আস্থাহীনতার এক প্রতিচ্ছবি।

তবে একই সঙ্গে, আমরা মনে করি—রাজনীতি শুধুই প্রযুক্তি আর ক্যারিশমার খেলা নয়। এটি জনগণের বিশ্বাস, নেতৃত্বের প্রজ্ঞা ও কাঠামোগত জবাবদিহিতার একটি সম্মিলিত চর্চা। মাস্ক সেই চর্চার ভেতর দিয়ে গেলে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে হয়তো একটি নতুন অধ্যায়ই শুরু হবে।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন