বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫

বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস হ্রাস: বিনিয়োগ সংকটে অর্থনীতির গতি শ্লথ, বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে জোর প্রয়োজন

বিশ্বব্যাংকের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে ৩.৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে জানুয়ারি মাসে সংস্থাটি এ প্রবৃদ্ধি ৪.১ শতাংশ হবে বলে অনুমান করেছিল। অর্থনীতির গতি কমে যাওয়ার পেছনে বিনিয়োগ হ্রাস, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকেই মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গণবিক্ষোভ, কারফিউ এবং ইন্টারনেট বন্ধ থাকার মতো ঘটনাগুলোর ফলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। এ সময়কালে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) নেমে আসে মাত্র ১০৪.৩৩ মিলিয়ন ডলারে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় তিনগুণ কম।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) তাদের এপ্রিল মাসের উন্নয়ন পূর্বাভাসে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪.৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩.৯ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধির ফলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চিত নীতিকাঠামো, করনীতির পরিবর্তন এবং দুর্বল অবকাঠামো বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ বেসরকারি বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বিনিয়োগ — উভয় ক্ষেত্রেই স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

তবে এ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশ সরকার গত এপ্রিল মাসে ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫’ আয়োজন করে। এতে বিশ্বের ৫০টি দেশ থেকে ৪১৫ জন বিদেশি প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন, যার মধ্যে চীন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বাধিক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। সামিটে প্রায় ৩,১০০ কোটি টাকার প্রাথমিক বিনিয়োগ প্রস্তাবনা আসে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বেসরকারি খাত, বিশেষত রপ্তানিনির্ভর তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে সর্বাধিক এফডিআই এসেছে টেক্সটাইল ও পোশাক খাতে (৪৩৬ মিলিয়ন ডলার) এবং ব্যাংকিং খাতে (২৩০ মিলিয়ন ডলার)। অন্যান্য খাতের মধ্যে ওষুধ, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও খাদ্য শিল্পে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্স করপোরেশন (IFC)-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, নীতির অনিশ্চয়তা ও করনীতির পরিবর্তন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি করছে। তদুপরি, দেশের অব্যবস্থাপনায় থাকা বন্দর পরিচালনা এবং টেকসই জ্বালানির অপ্রতুলতাও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

২০২৬ সালের এলডিসি উত্তরণ-এর পর বাংলাদেশের রপ্তানি সুবিধা হ্রাস পাবে, ফলে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখতে হলে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ, দক্ষ জনবল তৈরি এবং প্রযুক্তি নির্ভর শিল্পায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এফডিআই প্রবাহ বাড়াতে হলে দীর্ঘমেয়াদে কৌশল নির্ধারণ, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি, রপ্তানি বৈচিত্র্য, রিনিউয়েবল এনার্জি ও ডিজিটাল খাতে অগ্রাধিকার এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ ও অংশীদারত্ব গড়ে তুললে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি আবারও জোরদার করা সম্ভব হবে।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন