বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫

দিনের কিছু সময় নিয়মিত নফল ইবাদত

মানুষের আসল সম্পদ নেক আমল। আখেরাতের অনন্ত জীবনে নেক আমলই হবে মানুষের আসল পুঁজি। এর মাধ্যমে মানুষের দুনিয়ার জীবন যেমন সুখী ও প্রশান্তিময় হয়, তেমনি আখেরাতের জীবনও হয় ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ এবং নেয়ামতে পরিপূর্ণ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে নারী বা পুরুষ ঈমানদার অবস্থায় নেক আমল করবে অবশ্যই আমি তাদের উত্তম জীবন দান করব এবং অবশ্যই তাদেরকে তাদের সর্বোত্তম আমলের প্রতিদান দেব’ (সুরা নাহল : ৯৭)। এ জন্য আমাদের উচিত নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, জিকির, তেলাওয়াত, তাসবি-তাহলিল, দান-সদকা ইত্যাদি যাবতীয় নেক আমল সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পালন করা এবং সর্ব অবস্থায় তার ওপর অটল অবিচল থাকা। কেননা এগুলোই একজন মুসলমানের আসল পুঁজি ও প্রকৃত সঞ্চয়।

আমল হওয়া চাই নিয়মিত : আমাদের আমলগত অবক্ষয়-অবনতি এই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও অনেকে তো নেক আমল করিই না, আর যারাও বা একটু-আধটু করি তাও হয় অনিয়মিত ও অনিয়মতান্ত্রিক। অথচ যেকোনো নেক আমল একবার শুরু করার পর তা আমৃত্যু আঁকড়ে ধরা এবং তা পালন করে যাওয়া আমাদের কর্তব্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত করতে থাকো, যতক্ষণ না মৃত্যু আসে’ (সুরা হজ : ৯৯)। দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন, শোক-সন্তাপ, বিপদ-দুর্যোগ কোনো কিছুই যেন আমল থেকে দূরে না রাখতে পারে। বরং এসব প্রতিকূল মুহূর্তে আরও বেশি আমলের দিকে ফিরে আসতে হবে এবং ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা ওইসব ধৈর্যশীলকে সুসংবাদ দান করো যারা বিপদগ্রস্ত হওয়ার সময় বলে, আমরা তো আল্লাহর জন্য এবং তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী।’ (সুরা বাকারা : ১৫৬-১৫৭)

নিয়মিত আমল পছন্দনীয় : নিয়ম মেনে যেকোনো আমল নিয়মিত করা ছিল প্রিয়নবী (সা.)-এর পছন্দের শীর্ষে। হজরত মাসরুক বলেন, আমি আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, নবীজি (সা.)-এর কাছে কোন আমল সবচেয়ে প্রিয় ও পছন্দনীয় ছিল? তিনি বললেন, ‘নিয়মিত আমল’ (বুখারি ৬৪৬১)। আর কেনই বা নিয়মিত আমল তাঁর প্রিয় হবে না, অথচ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার কাছেও তা সর্বাধিক প্রিয়। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, আল্লাহর কাছে কোন আমল সর্বাধিক প্রিয়? তিনি উত্তর দিলেন, ‘যে আমল সর্বদা করা হয় চাই তা কম হোক’ (বুখারি : ৬৪৬৫)। আরেক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা সত্যের ওপর অবিচল থাকো, মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো এবং সুসংবাদ গ্রহণ করো। কেননা কাউকে তার আমল জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবে না। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, আপনাকেও না? বললেন, না, আমাকেও আমল জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, আল্লাহ তায়ালা আমাকে আপন রহমত দ্বারা পরিবেষ্টন করবেন। মনে রেখো আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে পছন্দের আমল হলো যা নিয়মিত করা হয় যদিও তা পরিমাণে হয় অল্প।‌’ (মুসলিম : ২৮১৮)

অনিয়মিত আমল অপছন্দনীয় : পক্ষান্তরে অনুকূল-প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে পরিবর্তনশীল অনিয়মিত আমল আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের অপছন্দনীয়। অবস্থা ও পরিস্থিতির শিকার হয়ে যারা আমল গ্রহণ করে কিংবা বর্জন করে তাদের নিন্দা করে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘কিছু মানুষ আছে যারা প্রান্তিকভাবে ইবাদত করে, কল্যাণপ্রাপ্ত হলে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে আর বিপদগ্রস্ত হলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারা দুনিয়া আখেরাত উভয় জগতে ক্ষতিগ্রস্ত। আর এটাই হলো বড় ক্ষতিগ্রস্ততা’ (সুরা হজ : ১১)। অন্যত্র বলেন,  ‘যখন মানুষের প্রতি আমি কোনো অনুগ্রহ করি তখন সে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং পার্শ্ব পরিবর্তন করে দূরে সরে যায়। আবার যখন তাকে কোনো অমঙ্গল স্পর্শ করে তখন সে বনে যায় লম্বা-চওড়া দোয়া প্রার্থনাকারী।’ (সুরা হা-মিম সাজদা : ৫১)

নিয়মিত আমলকারীর জন্য সুসংবাদ : যারা নিয়মিত নেক আমল করে এবং মৃত্যু পর্যন্ত নেক আমলের ওপর অবিচল থাকে তাদের জন্য পবিত্র কুরআনে বড় সুসংবাদ এসেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা বলেছে, আমাদের রব আল্লাহ! তারপর তারা তাতে থাকে অবিচল, নিশ্চয়ই তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হবে (এবং বলবে) যে, তোমরা কোনো ভয় করো না এবং কোনো কিছুর জন্য চিন্তিত হয়ো না আর আনন্দিত হয়ে যাও সেই জান্নাতের জন্য, যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেওয়া হতো।’ (সুরা হা-মীম সাজদা : ৩০)

আমল ধরে রাখার উপদেশ : সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) ইবাদত-বন্দেগিতে ছিলেন খুবই আন্তরিক, সচেষ্ট ও নিবেদিতপ্রাণ। সারা দিন রোজা রাখতেন এবং সারা রাত নামাজ পড়তেন। যখন নবীজি (সা.) তার আমল সম্পর্কে অবগত হলেন তখন বললেন, নামাজ-রোজার ব্যাপারে হজরত দাউদ (আ.)-এর কর্মপন্থা সর্বোত্তম। তিনি এক দিন রোজা রাখতেন, এক দিন বিরত থাকতেন। অর্ধরাত ঘুমাতেন, এক-তৃতীয়াংশ নামাজ পড়তেন, তারপর বাকি অংশ ঘুমাতেন। নবীজি (সা.)-এর বাণী শুনে আবদুল্লাহ (রা.) এভাবেই নামাজ-রোজা শুরু করলেন, এক দিন রোজা রাখতেন, এক দিন রোজা ছাড়তেন। রাতের কিছু অংশ ঘুমাতেন, কিছু অংশ ইবাদতে কাটাতেন। নবীজি (সা.) তার ব্যাপারে আশঙ্কা করলেন, হয়তো সে এভাবে আমল ধরে রাখতে পারবে না, তাই তাকে উপদেশ দিয়ে বললেন, হে আবদুল্লাহ, তুমি অমুকের মতো হয়ো না, সে রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন থাকত, কিন্তু তা ছেড়ে দিয়েছে। নবীজি (সা.)-এর সতর্কবাণী শোনার পর থেকে এক দিনের জন্যও আবদুল্লাহ (রা.) রাতের ইবাদত ছাড়েননি। আল্লাহর নবী (সা.)-এর ইহধাম ত্যাগের পর রোজা রাখা এবং রাত জেগে ইবাদত করা তার পক্ষে অনেক কষ্টদায়ক হয়ে পড়েছিল। লোকেরা দয়াপরবশ হয়ে তাকে বলত, আপনি তো অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, তারপরও কেন এত আমল করছেন? তখন তিনি উত্তর দিতেন, নবী (সা.) আমাকে যে আমল করা অবস্থায় রেখে গেছেন আমি কাল তাঁর সঙ্গে সে আমল ছাড়া অবস্থায় সাক্ষাৎ করতে অপছন্দ করি (শরহু রিয়াজুস সালিহীন-আহমদ হাতিবা : ৭/৫৮)। আল্লাহ সবাইকে নিয়মিত আমল করার তওফিক দিন।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন