বাংলাদেশে কোরবানির গরুর বাজার: বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন
- প্রান্তকাল ডেস্ক
- মে ৩০, ২০২৫
প্রতি বছর ঈদুল আজহা উপলক্ষে বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক গবাদিপশু কোরবানি দেওয়া হয়। দেশীয় খামার, অনলাইন হাট এবং ক্রেতা-বিক্রেতার আচরণ – সব মিলিয়ে কোরবানির পশুর বাজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে কোরবানির গরুর বাজারের সাম্প্রতিক অবস্থা, অনলাইন বিক্রয়ব্যবস্থার বিকাশ, খামারিদের চ্যালেঞ্জ এবং ক্রেতাদের জন্য করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হলো।
কোরবানির গরুর বাজার বিশ্লেষণ
বাংলাদেশ সম্প্রতি কোরবানির পশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী গত কয়েক বছরে দেশীয় উৎস থেকেই কোরবানির চাহিদা মিটছে এবং উদ্বৃত্ত পশুও অবশিষ্ট থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ পশু প্রস্তুত ছিল, যার মধ্যে প্রায় ৯১ লাখ পশু বিক্রি হয় এবং অবশিষ্ট ২৮ লাখ বিক্রি হয়নি । ২০২২ সালে চাহিদা ছিল প্রায় ৯৮ লাখ, আর সরবরাহ ছিল ১ কোটি ২১ লাখ (চাহিদার তুলনায় ~২৩ লাখ বেশি) । পরের বছর ২০২৩ সালে চাহিদা বেড়ে প্রায় ১ কোটি ৪ লাখ হলেও দেশীয় খামারগুলো প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ পশু যোগান দেয়, ফলে উদ্বৃত্ত থেকে যায় ~২১ লাখ । ২০২৪ সালেও প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ পশু প্রস্তুত ছিল, যা চাহিদার তুলনায় প্রায় ২২.৮ লাখ বেশি । ২০২৫ সালের ঈদুল আজহাতেও আনুমানিক ১ কোটি ২৮ লাখ পশু উপলভ্য থাকবে বলে ধারণা, যা চাহিদার তুলনায় ~২০.৬৮ লাখ বেশি । এই ক্রমবর্ধমান দেশীয় উৎপাদনের ফলে সরকার বারবার ঘোষণা দিচ্ছে যে কোরবানির জন্য বিদেশ থেকে গরু আমদানির প্রয়োজন নেই ।
বাংলাদেশে একসময় ভারতে অবৈধভাবে আসা গরুর উপর বাজার নির্ভর ছিল। তবে ২০১৫-২০১৭ সালের দিকে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে সীমান্ত দিয়ে গরু প্রবেশ অনেকাংশে কমে যায় । এর ফলে দেশীয় গরুর দাম কিছুটা বেড়েছিল এবং স্থানীয় কৃষকরা গরু পালনে উৎসাহিত হন । বিশেষজ্ঞদের মতে ২০১৮ সালের পর থেকে ঈদুল আজহার কোরবানির চাহিদার পুরোটা দেশীয় প্রাণিসম্পদ থেকেই মেটানো সম্ভব হয়েছে । ২০১৬ সালের পূর্বে ভারতীয় গরুর চাপে লোকাল খামারিরা লোকসানে থাকলেও এখন পরিস্থিতি উল্টে গেছে – বিদেশি গরু না আসায় তারা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন । এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতীয় গরুর অনিয়ন্ত্রিত প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় অনেক বেকার তরুণ নতুন করে গরুর খামার গড়ে তুলছেন, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে ।
সরবরাহ বেড়ে গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে গরুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। ২০২৪ সালের ঈদের আগে বিভিন্ন হাটে গরুর দাম গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩০% বেশি বলে ক্রেতারা অভিযোগ করেছেন । বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ) জানিয়েছে, এ বছরে হাটে জীবিত গরুর ওজন-অনুযায়ী মূল্য প্রতি কেজি ৫০০–৬০০ টাকা, যেখানে গত বছর ছিল ৪৮০–৫০০ টাকা । গরুর মাংসের খুচরা দামও রাজধানীতে কেজি প্রতি ৭৫০-৮০০ টাকা পর্যন্ত উঠে গেছে বলে জানা যায় । বিশেষজ্ঞদের মতে বাজারে সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও দাম বাড়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে: প্রথমত, পশুখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গরু পালনের খরচ বেড়েছে; দ্বিতীয়ত, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বাড়তি মুনাফা করতে চেষ্টা করছেন । ফিড বা খাদ্যের মূল্য গত বছরে প্রায় ৪০% পর্যন্ত বেড়েছে, যা সরাসরি মোটাতাজা করনের খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে । সরকার দাবি করেছে যে পর্যাপ্ত সরবরাহের কারণে দামে স্থিতিশীলতা আসবে , কিন্তু বাস্তবে ক্রেতারা উচ্চ মূল্যের চাপ অনুভব করছেন।
অনলাইন হাট ও কোরবানির ডিজিটাল বিক্রয়ব্যবস্থা
কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে কোরবানির পশু বিক্রিতে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম একটি নবতর সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে মহামারির সময়ে সরাসরি হাটের ভিড় এড়িয়ে অনেকেই অনলাইনে গরু কিনতে উদ্যোগী হন। এর ফলে সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে বেশ কিছু ডিজিটাল হাট চালু হয়েছে। সবচেয়ে বড় সরকারি উদ্যোগ ছিল digitalhaat.gov.bd, যা ই-ক্যাব, ekShop, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, বিডিএফএসহ বিভিন্ন পক্ষের যৌথ উদ্যোগে ২০২০ সাল থেকে চালু হয় । ২০২৩ সালে এই প্ল্যাটফর্মটি মাত্র ৯ দিনে (২০–২৮ জুন) ৫৬,৮২১টি পশু অনলাইনে বিক্রি করেছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৪২২ কোটি টাকা । তবে কোভিড পরবর্তী সময়ে অনলাইনে বিক্রির এই ঊর্ধ্বগতিতে কিছুটা মন্দা দেখা গেছে। ২০২১-২২ সালে অনলাইন বিক্রয় সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠলেও ২০২৩ সালে তা কিছুটা কমে এবং ২০২৪ সালে ডিজিটালহাটের বিক্রি আগের বছরের অর্ধেকে নেমে আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের পূর্বাভাস । ই-ক্যাব-এর নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম শোভন জানান, ক্রেতারা অনলাইনে উৎসাহী হলেও অনেক বিক্রেতা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে গরু দিতে আগ্রহী নন, কারণ সরাসরি হাটে চাহিদা অনুযায়ী দাম বাড়ানোর সুযোগ থাকে । অনলাইনে এক দামে আগাম বিক্রি করলে শেষ মুহূর্তের বেশি দামে বিক্রির সুযোগ হাতছাড়া হয় – এই মনস্তত্ত্বে কিছু খামারি ও পাইকার এখনও অনলাইন হাটে অনাগ্রহী ।
বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও অনলাইন হাট পরিচালনা করছে। দেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন মার্কেটপ্লেস বিক্রয়.কম প্রতি বছর “বিরাট হাট” ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে হাজারো গরুর বিজ্ঞাপন তালিকাভুক্ত করে এবং অনলাইন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে । এছাড়া বেঙ্গল মিট কোরবানি, সাদীক এগ্রো, খাস ফুড প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান অনলাইনে গরু বিক্রি ও কোরবানির পূর্ণাঙ্গ সেবা প্রদান করে থাকে । উদাহরণস্বরূপ, প্রাণিসম্পদ খাতের ই-কমার্স সাইট Othoba.com গত ২০২৩ সালে অনলাইনে প্রায় ৭০টি গরু বিক্রি করেছিল (মোট বিক্রয়মূল্য ~১.২ কোটি টাকা), আর ২০২৪ সালের ঈদের আগে আগেই তারা ১৫০টিরও বেশি গরু অনলাইনে বিক্রি করেছে (~২.৫ কোটি টাকার বিক্রয়) । ছোট-বড় অন্যান্য ফার্মও নিজস্ব ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেইজ কিংবা অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইনে পশু বিক্রি করছে এবং ধীরে ধীরে এই সংখ্যা বাড়ছে ।
অনলাইন হাটের কিছু স্পষ্ট সুবিধা রয়েছে। ক্রেতারা ঘরে বসে বিভিন্ন জেলার খামার থেকে পশু বাছাই করতে পারছেন, ডিজিটাল পেমেন্টের সুবিধা পাচ্ছেন এবং নির্দিষ্ট ফি-এর বিনিময়ে বাসায় পশু হোম ডেলিভারি ও কসাইখানায় জবাই-পরিবহন সেবা পর্যন্ত নিচ্ছেন । বিশেষ করে শহুরে ব্যস্ত মানুষ ও প্রবাসীরা অনলাইন হাটকে সময় ও পরিশ্রম বাঁচানোর উপায় হিসেবে দেখছেন। অনেক ডিজিটাল হাটে ওজনের ভিত্তিতে নির্ধারিত দাম (প্রতি কেজি লাইভ ওয়েট) রাখা হচ্ছে, ফলে দরদামের ঝামেলা কমে যাচ্ছে এবং ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই স্বচ্ছ ধারণা থাকছে । তাছাড়া অনলাইনে একাধিক প্ল্যাটফর্ম ঘুরে মূল্য তুলনা করে সেরা দর পাওয়ার সুযোগ থাকে, যা স্থানীয় হাটে সবসময় সম্ভব হয় না।
এর বিপরীতে চ্যালেঞ্জ বা সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। অনেক ক্রেতা সরাসরি পশু চোখে না দেখে আস্থা পাচ্ছেন না এবং ছবিতে বা ভিডিওতে দেখে গরুর স্বাস্থ্যের ভাল-মন্দ পুরোপুরি বোঝা কঠিন হচ্ছে । আবার গ্রামীণ ছোট খামারিরা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে অভ্যস্ত নন বলে অনেক ভালো মানের দেশীয় পশু অনলাইনে ওঠেই না । অনলাইনে লেনদেনের ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা একটি বড় বিষয় – অগ্রিম টাকা দিয়ে ঠকানোর শিকার হওয়ার শঙ্কা অনেকের মাঝেই আছে। এজন্য সরকারি ডিজিটালহাটসহ কিছু উদ্যোগ ক্রেতা-বিক্রেতার জন্য অভিযোগ গ্রহণ ও সমাধানের সিস্টেম রেখেছে এবং অনলাইনে প্রতারনা রোধে নির্দেশিকা প্রণয়ন করেছে । তবু এখনো ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে অনলাইন হাট সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। বিক্রেতাদের ক্ষেত্রেও অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে উপযুক্ত ক্রেতা খুঁজে পেতে সময় লাগতে পারে, যেটি সরাসরি হাটে একদিনে কেনাবেচা হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, অনলাইন হাটের জনপ্রিয়তা প্রতি বছরে বাড়লেও এটিকে মূলধারায় আনতে আরও সময়, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন ।
খামারিদের প্রস্তুতি ও চ্যালেঞ্জ
কোরবানির মৌসুম কেন্দ্র করে খামারিদের কয়েক মাসব্যাপী প্রস্তুতি চলে। গরুকে মোটাতাজা করা, সঠিক খাদ্য যোগান, পরিবহনের ব্যবস্থা, রোগব্যাধি প্রতিরোধ – বহু বিষয় সামাল দিয়ে তাদের ঈদের বাজার ধরতে হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশি খামারিরা যেমন সুফল পাচ্ছেন, তেমনি কিছু চ্যালেঞ্জ-এর মুখেও পড়ছেন।
খাদ্য ও পশুখাদ্যের ব্যয়
গরু মোটাতাজাকরণের সবচেয়ে বড় উপকরণ হলো খাদ্য বা ফিড। বিগত বছরে গরুর খাদ্যশস্য (ভুট্টা, খড়, দানাদার ফিড ইত্যাদি) এবং তুষ, খড় ইত্যাদির দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিডিএফএ জানায়, কোভিড-পরবর্তীকালে ফিডের মূল্যবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক মন্দার ফলে ছোট-বড় ১৫-২০% খামার বন্ধ হয়ে গেছে । বিশেষ করে ২০২২-২৩ সালে নানা কারণে গরুর খাবারের দাম প্রায় ৩০-৪০% বাড়ে, যা খামারিদের লাভ কমিয়ে দিয়েছে । বর্তমানে এক কেজি কনসেন্ট্রেট ফিডের দাম প্রায় ৫০-৫৫ টাকা এবং উন্নত পদ্ধতিতে চাষকৃত ঘাসের কেজি ৪-৬ টাকা খরচ পড়ে বলে সরকারের হিসাব । খাবারের এই অতিরিক্ত ব্যয় শেষ পর্যন্ত কোরবানির গরুর দামে প্রতিফলিত হচ্ছে। অনেক খামারি খরচ সামলাতে না পেরে গরুর সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন বা ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। সরকারি পর্যায়ে খামারিদের সহায়তা দিতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে – যেমন স্বল্পমূল্যে গরুর খাদ্য উপকরণ সরবরাহ, বিকল্প খাদ্য (উদাহরণস্বরূপ ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র বা ইউএমএস পদ্ধতি) ব্যবহারে উৎসাহ এবং উপজেলায় উপজেলায় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের পরামর্শদান ইত্যাদি। খাদ্যব্যয়ের চাপ কমাতে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে চারা ঘাস উৎপাদন ও স্থানীয়ভাবে খাদ্য উৎপাদনের উপর জোর দিতে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন।
পরিবহন ও বাজার ব্যবস্থাপনা
খামার থেকে হাট পর্যন্ত গরু আনা-নেয়া ও বাজারজাত করণে নানা ধরণের জটিলতা রয়েছে। অনেক সময় পথিমধ্যে চাঁদাবাজি, যানবাহনের অভাব বা দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। এসব সমস্যা মোকাবেলায় সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ঈদের আগে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে সহজ পরিবহন ও বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতের নির্দেশনা দেওয়া হয় । জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন কোরবানির পশুবাহী ট্রাক, নৌকা বা যানবাহনগুলোকে কোথাও অহেতুক হয়রানি বা বাধার মুখে না পড়তে হয় । প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বিভিন্ন স্থানে কন্ট্রোল রুম (হটলাইন ১৬৩৫৮) চালু করে যাতে খামারি বা বিক্রেতারা যেকোনো সমস্যায় সহযোগিতা চাইতে পারেন । আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় হাটগুলোতে অতিরিক্ত পুলিশ ও কমিউনিটি টিম মোতায়েন করা হয় এবং অনেক এলাকায় পশুর হাটকে কেন্দ্র করে বিশেষ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা থাকে। তবু দূরদূরান্ত থেকে পশু এনে হাটে তুলতে পরিবহন ব্যয় ও ঝুঁকি খামারিদের একটি বড় দুশ্চিন্তা। এ বছর জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে ট্রাক ভাড়াও বেড়েছে বলে অনেকের অভিযোগ। সরকার যদিও বলছে চাহিদা-সরবরাহ ভারসাম্য থাকায় দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে , কিন্তু অতিরিক্ত পরিবহন খরচ শেষ পর্যন্ত গরুর বিক্রয় মূল্যে যুক্ত হচ্ছে। তাই অনেক খামারি স্থানীয় পর্যায়ের হাট বা অনলাইন বিক্রির দিকে ঝুকছেন যাতে দূরে পরিবহন করতে না হয়।
পশুর স্বাস্থ্যসেবা ও মান নিয়ন্ত্রণ
খামারিরা তাঁদের পশুর স্বাস্থ্যরক্ষা ও মান ভালো রাখতে সদা প্রচেষ্ট। সরকারিভাবে প্রাণিসম্পদ বিভাগ মাঠপর্যায়ে ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পেইন, পশুর চিকিৎসা সেবা এবং পরামর্শ দিয়ে আসছে । ডিপার্টমেন্ট অব লাইভস্টক সার্ভিসেস (DLS) এর কর্মকর্তারা ঈদের আগে প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে খামারিদের সহায়তা করছেন এবং যেকোনো রোগের প্রাদুর্ভাব প্রতিহত করতে প্রস্তুত রয়েছেন । সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একদিকে যেমন অ্যানথ্রাক্স,Foot-and-Mouth রোগের টিকা খামারিদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে, অন্যদিকে গরু মোটাতাজাকরণে ক্ষতিকর স্টেরয়েড/হরমোন ব্যবহার রোধে জোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ খামারিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে যাতে তারা মোটাতাজাকরণে প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন এবং ক্ষতিকর ইনজেকশন বা ওষুধ প্রয়োগ না করেন । ২০১০ সালের প্রাণিখাদ্য আইনে বেশ কিছু স্টেরয়েড (যেমন ডেকাসন, ওরাডেক্সন ইত্যাদি) গরু মোটাতাজাকরণে ব্যবহারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এবং মাঠপর্যায়ে ভেটেরিনারি ডাক্তাররা এটি মনিটর করেন । দেশের সচেতন খামারিরাও এখন “ইনজেকশনমুক্ত” বা প্রাকৃতিক উপায়ে পালিত গরু বিক্রির প্রচারণা চালাচ্ছেন ক্রেতাদের আস্থা অর্জনের জন্য ।
গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রণে সরকার হাটগুলোতেও তৎপর থাকে। বেশিরভাগ হাটে পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম থাকে, যারা সন্দেহজনক অসুস্থ পশু আলাদা করে ফেলে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক সিটি কর্পোরেশনের হাটে পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ওজন মাপা, এবং বিক্রির পূর্বে পরিচ্ছন্নতা পরীক্ষা করার বিধি জারি করেছে। এতে একদিকে ক্রেতারা আশ্বস্ত হন যে পশুটি স্বাস্থ্যকর, অন্যদিকে খামারিরাও ভালো পশুর জন্য ন্যায্য দাম পান। বিশেষজ্ঞদের মতে অতীতে সীমান্তপথে আসা ভারতীয় গরুর মাঝে নানা রোগ (যেমন চর্মরোগ, ক্ষুরা রোগ) দেখা যেত এবং সেগুলোর মাংসেও মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল । এখন স্থানীয় গরুর মাংস তুলনামূলক বেশি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর বলে গণ্য হচ্ছে । সরকার “বাকনা বাচ্চা বিতরণ”, উন্নত জাতের নিরীহ প্রাণি উদ্ভাবন ও খামারিদের মাঝে বিতরণের মাধ্যমে গুণগত মানোন্নয়নেও কাজ করছে । সব মিলিয়ে, স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে পশু প্রস্তুত করা এবং শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের নিরাপদ মাংস পাওয়া নিশ্চিত করতে সরকার ও খামারিদের সমন্বিত উদ্যোগ চলছে।
চোরাচালান ও বিদেশি গরুর প্রভাব
দেশীয় কোরবানির পশুর বাজারে পার্শ্ববর্তী দেশের গরু দীর্ঘকাল প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে ভারত থেকে গরু চোরাচালান হয়ে আসা একটি পরিচিত সমস্যা, যা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ হয়ে স্থানীয় কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হন। অতীতে কোরবানির মৌসুম আসার আগমুহূর্তে হাজার হাজার গরু অবৈধ পথে সীমান্ত পেরিয়ে দেশে ঢুকত এবং সস্তায় বিক্রি হত বলে স্থানীয় খামারিরা ন্যায্য দাম পেতেন না । ২০১৫ সালের পর থেকে দুই দেশের সরকার কড়া অবস্থান নেওয়ায় এ ধরণের চোরাচালান আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় । ২০১৭ সালের পর ভারতীয় গরুর ঢল প্রায় সম্পূর্ণ থেমে গেছে বলে গবেষকরা উল্লেখ করেন । এর ফলশ্রুতিতে ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে কোরবানির পশু যোগান দিতে সক্ষম হয়েছে এবং খামারিরা তাদের পশুর ভালো দাম পাচ্ছেন । একজন খামারি জানিয়েছেন, আগে ভারতীয় গরু বাজারে এলে গরুর দাম পড়ে যেত এবং তাদের লোকসান গুনতে হতো, এখন সেই চাপ নেই ।
তবে সম্পূর্ণভাবে চোরাচালান বন্ধ বলা যায় না। সীমান্তবর্তী কয়েকটি পথ (যেমন চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের কিছু পয়েন্ট, যশোর বেনাপোল ইত্যাদি) দিয়ে এখনো কিছু মিয়ানমার ও ভারতীয় গরু ঢোকার খবর পাওয়া যায় । ২০২4 সালের মে মাসেও সীমান্তে চোরাই গরু আনতে গিয়ে দুইজন নিহত হওয়ার ঘটনা সংবাদে আসে । এসব গরু অবৈধভাবে এলে বাজারে দামের অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে এবং স্থানীয় খামারিরা ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা রয়েছে । তাই সরকার ঈদের আগে সীমান্ত জেলাগুলোতে বিশেষ নজরদারি এবং অভিযানের নির্দেশ দিয়েছে । মন্ত্রী পর্যায়ে ঘোষণা আসে যে চোরাচালান রোধে বিজিবি, পুলিশসহ সব সংস্থা কঠোর থাকবে এবং প্রয়োজনে সেন্সর/ড্রোন প্রযুক্তিও ব্যবহার করা হবে। চোরাপথে গরু আসা ঠেকাতে সীমান্তে অস্থায়ী হাট বসানো, কমিউনিটি সচেতনতা তৈরি, চোরাচালানে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা ইত্যাদি পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এর পাশাপাশি, বৈধভাবে বিদেশি গরু বা মাংস আমদানিও entপনিবেশিক না করার সিদ্ধান্ত রয়েছে, যাতে স্থানীয় উদ্যমী তরুণ খামারিদের বিনিয়োগ সুরক্ষিত থাকে । ফলত ২০২৩ ও ২০২৪ সালে সরকার কোনো দেশ থেকেই কোরবানির আগে গরু আমদানির অনুমতি দেয়নি।
সব মিলিয়ে, চোরাচালান কমে আসা ও আমদানি বন্ধ থাকায় দেশীয় খামারিরা বর্তমানে কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছেন। তারা বেশি দামে গরু বিক্রি করতে পারায় উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছেন এবং গো-খামারের সংখ্যা বেড়েছে । অবশ্য ভোক্তাদের জন্য এতে মাংসের দাম কিছুটা বাড়লেও দেশীয় শিল্প সুরক্ষিত হচ্ছে এবং প্রাণিসম্পদ খাতের সার্বিক উন্নয়ন হচ্ছে।
ক্রেতাদের জন্য পরামর্শ ও সতর্কতা
কোরবানির পশু কেনা একটি বড় দায়িত্বের কাজ। সঠিক পশুটি নির্বাচন, প্রতারণা এড়ানো এবং স্বাস্থ্যকর পশু ক্রয় নিশ্চিত করতে কয়েকটি পরামর্শ ও সতর্কতা মেনে চলা উচিত:
গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সঠিক পশু নির্বাচন
- বয়স ও দাঁত পরীক্ষা করুন: শরিয়তের বিধান অনুযায়ী কোরবানিযোগ্য গরুর বয়স কমপক্ষে ২ বছর হতে হবে। গরুর সামনের দাঁত দেখে বয়স আন্দাজ করা যায় – ২ বছরে ২টি স্থায়ী দাঁত, ৩ বছরে ৪টি, ৪ বছরে ৬টি এবং ৫ বছরে ৮টি দাঁত পূর্ণ হয়। স্বাস্থ্যবান গরুর দাঁত মজবুত ও উজ্জ্বল দেখাবে । এছাড়া ছাগল/ভেড়া হলে অন্তত ১ বছর বয়স জরুরি।
- খাবার গ্রহণ ক্ষমতা দেখুন: একটি সহজ পরীক্ষা হলো গরুর সামনে সামান্য ঘাস বা খাবার ধরে দেখা। স্বাস্থ্যবান গরু ক্ষুধার্ত থাকলে তৎক্ষণাৎ জিহ্বা বের করে খাবার টেনে নিয়ে চিবাবে, দুর্বল বা অসুস্থ পশু খাবারের প্রতি অনাগ্রহ দেখাতে পারে । সচল ও সতেজ গরু সাধারণত সুস্থ থাকে।
- শারীরিক লক্ষণ পর্যবেক্ষণ: গরুর নাকটি ভেজা ও ঠাণ্ডা আছে কিনা দেখুন – সুস্থ গরুর নাসিকা একটু স্যাঁতসেঁতে ও ঠাণ্ডা থাকে, শুকনা গরম নাক জ্বরের লক্ষণ হতে পারে। গরুর চোখ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার কিনা এবং লালা বা নাক থেকে অনবরত পানি পড়ছে কিনা খেয়াল করুন। সুস্থ প্রাণীর কান সচল ও সতর্ক ভঙ্গিতে থাকবে।
- হাত দিয়ে পরীক্ষা: গরুর শরীরে অস্বাভাবিক ফোলা ভাব আছে কিনা দেখার জন্য আঙুল দিয়ে গায়ের চামড়ায় হালকা চাপ দিন। যদি চাপ দেওয়া স্থানে গভীর দেবে যায় এবং ছেড়ে দেবার পরও দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না আসে, তাহলে বুঝতে হবে গরুটিকে কৃত্রিম উপায়ে মোটা করা (স্টেরয়েডজনিত পানি জমে ফোলা) হয়েছে । প্রাকৃতিকভাবে মোটাতাজা গরুর পিঠের কুঁজ ও শরীর হবে মাংসপুষ্ট কিন্তু খুব নরম ফোলা নয়। অতিরিক্ত মোটা বা অস্বাভাবিক গোলগাল গরুর তুলনায় মাঝারি গড়নের দৃঢ় স্বাস্থ্যযুক্ত গরু কেনাই নিরাপদ ।
- শারীরিক ত্রুটি পরীক্ষা: গরুর গায়ে কোনো ক্ষতচিহ্ন, ফোস্কা, ঘা ইত্যাদি আছে কিনা ভালভাবে দেখুন। শিং ভাঙা, কান কাটা, লেজের আগা খোঁড়া, দাঁতে সমস্যা – এসব ত্রুটি থাকলে এড়িয়ে চলা উচিত । পা ও খুর ভালোভাবে দেখুন, গরু লঙ্গড়িয়ে হাঁটছে কি না লক্ষ্য করুন। এছাড়া গাভী জাতীয় পশু কিনলে অবশ্যই দেখে নিন গর্ভবতী নয় (গর্ভবতী পশু কোরবানি করা ধর্মমতে নিষিদ্ধ) ।
- স্থানীয় জাতের অগ্রাধিকার: দেশের স্থানীয় জাতের বা খামারের গরু সাধারণত কাছাকাছি এলাকা থেকে আনা হয় এবং দীর্ঘপথ পরিবহনের ধকল পোহাতে হয়নি। বিদেশি বা দূর থেকে আসা গরু দীর্ঘ জার্নিতে দুর্বল হতে পারে। তাই সম্ভব হলে পরিচিত খামারের দেশীয় গরু কিনুন, যাতে তাজা ও স্বাস্থ্যকর অবস্থায় থাকে ।
- বিশেষজ্ঞ সঙ্গে নিন: যদি আপনি নিজে গরুর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খুব অভিজ্ঞ না হন, তবে পরিচিত কোনো পশু চিকিৎসক বা অভিজ্ঞ ব্যক্তি সঙ্গে নিয়ে হাটে যান। অভিজ্ঞ চোখ অনেক সূক্ষ্ম বিষয় ধরে ফেলতে পারে যা সাধারণ ক্রেতার নজরে নাও আসতে পারে ।
প্রতারণা এড়ানোর জন্য করণীয়
- দিনের আলোতে ক্রয়: গরু কেনার জন্য দুপূর/বিকেলবেলা সবচেয়ে উপযুক্ত সময়, যেন পরিষ্কার আলোয় পশুটি ভালো করে দেখা যায়। অন্ধকারে বা রাতের বেলায় হাটে কেনাকাটা করলে অসুস্থতা বা ত্রুটি অনেক সময় চোখ এড়িয়ে যায় এবং প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে । অনেক অসাধু ব্যবসায়ী রাতে কম আলোতে গরু বিক্রি করতে চায় যাতে গরুর সত্যিকারের অবস্থা গোপন রাখা যায়।
- বিশ্বাসযোগ্য হাট ও বিক্রেতা নির্বাচন: যেখানে সম্ভব, সরকারি/সিটি কর্পোরেশন অনুমোদিত হাট থেকে পশু কিনুন। গ্রামের পথে ঘুরে বেড়ানো ফড়িয়া বা মাঝিদের কাছ থেকে কম দামে কিনতে গেলে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নির্ভরযোগ্য খামারি বা ব্র্যান্ড (যেমন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত খামার বা পরিচিত অনলাইন সেলার) থেকে কিনলে নিরাপদ। অনলাইনে কিনলে সেই প্ল্যাটফর্মের রিভিউ/রেটিং দেখে নিন, পূর্বের ক্রেতাদের প্রতিক্রিয়া পড়ুন।
- ওজন ও দাম যাচাই: বাজারে অনেক সময় গরুকে পানি খাইয়ে বা ঢেঁকি শাক খাইয়ে ফুলিয়ে ওজন বেশি দেখানো হয়। তাই সম্ভব হলে হাটের ওজনস্কেলে ওজন মেপে দাম ঠিক করুন, অথবা অভিজ্ঞতায় ওজন অনুমান করে প্রতিকেজি মূল্যে হিসাব করুন। অনলাইনে যেসব বিক্রেতা প্রতি কেজি লাইভ ওয়েট মূল্যে গরু দিচ্ছেন, তারা সাধারণত ওজন যাচাইয়ের বিষয়টি গুরুত্ব দেন, এতে প্রতারণার সুযোগ কমে।
- লেনদেনে সতর্কতা: হাটে কেনাকাটায় নগদ টাকার লেনদেন হয়, তাই সতর্ক থাকুন। ভিড়ের মধ্যে পকেটমার বা ছিনতাইয়ের ঝুঁকি থাকে, তাই টাকা ও মোবাইল নিরাপদে রাখুন । বড় অঙ্কের টাকা এক সাথে না এনে মোবাইল ব্যাংকিং/ব্যাংক চেকের সুবিধা থাকলে বিবেচনা করুন। অনলাইনে অগ্রিম পুরো টাকা পাঠাবেন না – সম্ভব হলে ক্যাশ অন ডেলিভারি বা অর্ধেক অগ্রিম/অর্ধেক ডেলিভারির সময় এই পদ্ধতি অনুসরণ করুন, যাতে বিক্রেতার প্রতি নির্ভরশীলতা ও ঝুঁকি কমে।
- প্রমাণ রাখুন: গরু কেনার সময় বিক্রেতার সাথে লেনদেনের একটি প্রামাণিক রশিদ বা চুক্তিপত্র রাখুন যেখানে গরুর বর্ণনা, ওজন, দাম এবং বিক্রেতার জাতীয় পরিচয়/মোবাইল নম্বর উল্লেখ থাকবে। অনলাইনে কেনাকাটা করলে সমস্ত মেসেজ/রসিদ সংরক্ষণ করুন। এতে পরবর্তীতে কোনো জটিলতা এলে আইনি ব্যবস্থা বা অভিযোগের জন্য ভিত্তি থাকবে।
অনলাইন বনাম প্রচলিত হাট: সুবিধা-অসুবিধা তুলনা
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কেনার সুবিধা: ঘরে বসে অনেক বিক্রেতার পশু একসাথে দেখা যায়, সময় ও পরিশ্রম সাশ্রয় হয়। বিশেষ করে কর্মব্যস্ত কিংবা দূরে অবস্থানকারী মানুষ অনলাইনে সহজেই পছন্দের গরু বেছে নিতে পারেন। ডিজিটাল পেমেন্ট, হোম ডেলিভারি, এবং কিছু ক্ষেত্রে কোরবানির পর মাংস বাসায় পৌঁছে দেওয়ার সেবা পাওয়া যায় । অনলাইনে প্রতিটি গরুর বিস্তারিত বিবরণ (বয়স, ওজন, জাত) ও ছবি/ভিডিও থাকে, যা প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক। অনেক অনলাইন সেলার ফিক্সড-প্রাইস বা ওজন অনুযায়ী স্ট্যান্ডার্ড রেট দেয়, দরদামের ঝামেলা নেই। তাছাড়া অনলাইনে আগাম কিনে রাখলে ঈদের আগে শেষ মুহূর্তের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির ঝামেলা পোহাতে হয় না।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সীমাবদ্ধতা: সরাসরি না দেখার কারণে পশুর আসল অবস্থা বোঝার ঝুঁকি থাকে। ছবিতে ঝকঝকে দেখালেও বাস্তবে গরু খুব মোটা নাও হতে পারে কিংবা অসুস্থতা ধরা নাও পড়তে পারে। অনেক ক্রেতা-মনের ভরসা ও বিশ্বাস স্থাপন কঠিন হয় অনলাইনে, বিশেষত অতীতে কেউ প্রতারিত হয়ে থাকলে । গ্রামাঞ্চলের অনেক খামারি অনলাইন বিক্রিতে অভ্যস্ত নয়, তাই পছন্দের পশু অনলাইনে নাও পেতে পারেন । অনলাইনে কখনো কখনো ভুল তথ্য বা ওজন বাড়িয়ে বলার অভিযোগও শোনা যায়। সবচেয়ে বড় বিষয়, অনলাইন ডিলivery বা অ্যাডভান্স পেমেন্টে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা (যদিও সংখ্যায় কম) কিন্তু আছে – যেমন টাকা নিয়ে গরু না দেওয়া বা কাঙ্ক্ষিত গরুর বদলে অন্য গরু পাঠানো। তাই শুধু বিশ্বস্ত ও পরিচিত প্ল্যাটফর্ম (সরকারি ডিজিটাল হাট, বিখ্যাত খামার বা ই-কমার্স) ব্যবহার করা উচিত এবং সম্ভব হলে হোম ডেলিভারির সময় দেখে গ্রহণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সরাসরি হাটে কেনার সুবিধা: ক্রেতারা নিজ চোখে পশু দেখে, হাত দিয়ে পরীক্ষা করে কিনতে পারেন – যা অনলাইনে সম্ভব নয়। হাটে অনেক বিক্রেতার মধ্যে মোখোমুখি দরদাম করা যায় এবং বেশিরভাগ সময়ে বাজারদর অনুযায়ী সামঞ্জস্যপূর্ণ মূল্যেই গরু পাওয়া যায়। পছন্দ হলে সাথে সাথেই কিনে তাৎক্ষণিক নিয়ে আসা যায়, আলাদা ডেলিভারির অপেক্ষা নেই। কোনো মধ্যস্থতাকারী ছাড়া সরাসরি কৃষকের কাছ থেকেও অনেক সময় হাটে কেনা যায়, এতে দুপক্ষই লাভবান হন। তাছাড়া হাটের পরিবেশ ও ঈদের কেনাকাটার আমেজ অনেকের কাছে আনন্দের অংশ। কেউ কেউ দলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হাটে যান, এটা তাদের ঐতিহ্যের অংশ।
সরাসরি হাটের অসুবিধা: প্রচণ্ড ভিড়, গরম ও কাদাপানি মাড়িয়ে হাটে ঘুরে ঘুরে গরু দেখা শারীরিকভাবে কষ্টসাধ্য হতে পারে, বিশেষ করে বয়স্ক বা অসুস্থ মানুষের জন্য। শহরের হাটগুলোতে যানজট ও পার্কিং সমস্যা বড় ঝক্কি। হাটে অসাধু কিছু ব্যাপারী বিভিন্ন ফন্দি (যেমন পানি খাইয়ে ওজন বাড়ানো, রং মেখে অসুস্থতা ঢাকা) করে থাকতে পারে, সতর্ক না থাকলে ঠকার আশঙ্কা আছে। হাট থেকে কেনা পশু নিজ দায়িত্বে পরিবহন করে বাড়ি আনতে হয়, এতে বাড়তি খরচ ও ঝামেলা পোহাতে হয়; এমনকি পথিমধ্যে দুর্ঘটনা বা পশুর অসুস্থ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও থাকে। অনলাইনে যেভাবে কিছু সেবায় বাড়িতে পৌঁছে দেয়, হাটে সে সুবিধা নেই। তাছাড়া ঈদ ঘনিয়ে এলে হাটে দাম চড়া হয়ে যেতে পারে, তখন পছন্দের পশু বাজেটের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সিদ্ধান্ত: অনলাইন বনাম সরাসরি হাট – কোনটি বেছে নেবেন তা নির্ভর করে ব্যক্তিগত পছন্দ, অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনের উপর। যাঁরা পশু নির্বাচন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন বা সময় কম, তাঁরা সরকার-স্বীকৃত অনলাইন হাট থেকে কিনতে পারেন, তবে সতর্ক থেকে এবং বিশদ যাচাই করে। আর যারা নিজেদের চোখে দেখে নিশ্চিত হতে চান এবং হাটের পরিবেশ উপভোগ করতে চান, তাঁরা পরিচিত কাউকে সঙ্গে নিয়ে সরাসরি হাট থেকেই কিনুন। উভয় ক্ষেত্রেই সাবধানতা ও সঠিক জ্ঞান ব্যবহার করলে নিরাপদে এবং সফলভাবে কোরবানির পশু কেনা সম্ভব।
উপসংহার
বাংলাদেশে কোরবানির গরুর বাজার ক্রমশ দেশীয় উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে এবং প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিক্রয়ব্যবস্থা পাল্টাচ্ছে। চাহিদা ও জোগানের সূক্ষ্ম সমন্বয়ে পুরো বাজার পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে সরকার আমদানি নিষিদ্ধ রেখে স্থানীয় খামারিদের সুরক্ষা দিচ্ছে এবং বাজার স্থিতিশীল রাখতে চেষ্টা করছে। অনলাইন হাটের প্রসার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যদিও তা এখনও সহায়ক মাধ্যম হিসেবে আছে – মূলধারার বিকল্প হতে কিছুটা সময় লাগবে। খামারিরা নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হলেও সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা প্রশিক্ষণ, সহায়তা ও নজরদারি বাড়াচ্ছে যেন নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্যকর পশু নিশ্চিত হয়। সর্বোপরি, ক্রেতাদের সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি – সঠিক পশু নির্বাচন, ন্যায্য মূল্য প্রদান এবং প্রতারণা থেকে সাবধান থেকে কোরবানি করলে তবেই ঈদুল আজহার মূল আনন্দ অর্থপূর্ণ হবে।
এই বিভাগের আরও খবর
বিশ্বকে শীতল রাখার বিপ্লব: ‘রেভল্যুশনারি’ কুলিং প্রযুক্তির সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
এক সময় দিল্লির গ্রীষ্ম মানেই ছিল গরমে হাঁসফাঁস…
ইউক্রেন কিভাবে বিশ্বের অন্যতম ডিজিটাল দেশ হয়ে উঠলো
রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ আগ্রাসনের দিনে, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি,…
চাঁদের গা ঘেঁষে মহাজাগতিক হুমকি: ধেয়ে এলো ‘সিটি কিলার’ গ্রহাণু
চলতি জুনে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের নজর ছিল এক মহাজাগতিক…
ইহুদি রাষ্ট্র ৮০ বছরের বেশি টিকে না—ধারণার উৎস, ধর্মীয় ইঙ্গিত, ইতিহাস ও সমসাময়িক বিশ্লেষণ
“ইহুদি রাষ্ট্র ৮০ বছরের বেশি টিকে না”—সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য…
বুদ্ধিমান ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য
✍️ বিশেষ প্রবন্ধ মানুষের মস্তিষ্কে জন্মগতভাবে চিন্তা করার…
সর্বশেষ খবর
1.
4.
জনপ্রিয় বিভাগ সমূহ
আরও পড়ুন
সাবেক আইনমন্ত্রীর বান্ধবী তৌফিকা করিমের ৮৭ কোটি টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ
সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) তৌফিকা করিমের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবসহ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি…
পিবিআই’র অভিযানে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের ৫ সদস্য গ্রেফতার
রাজধানীতে বিশেষ অভিযানে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (পিবিআই)। এসময় নগদ ৭০ লাখ টাকা…
দুর্গাপূজা ঘিরে সারাদেশে পুলিশি তৎপরতা: ৭১ হাজারের বেশি সদস্য মোতায়েন
শারদীয় দুর্গোৎসবকে ঘিরে সারাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশে পূজা শুরু হয়েছে। প্রায় ৩২ হাজার মণ্ডপে চলছে পূজার আয়োজন। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ…
লাদাখে সোনম ওয়াংচুকের গ্রেপ্তার নিয়ে মুখ খুললেন ওমর আবদুল্লাহ ও মেহবুবা মুফতি
লাদাখে জেন-জি বিক্ষোভের পর সমাজকর্মী সোনম ওয়াংচুকের গ্রেপ্তারকে ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক’ অভিহিত করেছেন জম্মু-কাশ্মীরের শীর্ষ দুই নেতা। শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) গ্রেপ্তারের…
টেকনাফে যৌথ অভিযানে ১ লাখ ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার, পাচারকারী গ্রেফতার
কক্সবাজারের টেকনাফে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশের যৌথ অভিযানে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ এক মাদক পাচারকারীকে আটক করা হয়েছে। এসময়…
লালবাগে ব্যাংক কর্মকর্তার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার
নিজের গলায় বটির আঘাত নাকি হত্যা, তদন্তে পুলিশ স্টাফ রিপোর্টার।। রাজধানীর লালবাগের একটি বাসা থেকে নজরুল ইসলাম (৪৩) নামে এক…
নারায়ণগঞ্জে স্ত্রী হত্যার দুই বছর পর পিবিআইয়ের তদন্তে মূল রহস্য উদ্ঘাটন
শ্যালিকার সঙ্গে পরকীয়ার জেরে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী খুন, আদালতে স্বীকারোক্তি নারায়ণগঞ্জে দুই বছর আগে সংঘটিত গৃহবধূ সুমা আক্তার (৩০) হত্যা…
টঙ্গী অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ ফায়ার ফাইটার নাঈমের মৃত্যু
গাজীপুরের টঙ্গীতে অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন থাকা ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর খন্দকার জান্নাতুল নাঈম (৩৫) মারা গেছেন। শনিবার সকাল ১০টার…